বীর-জারা: সীমান্তের কাঁটাতার পেরিয়ে গিয়েছিল যে ভালোবাসা!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
ষোলো বছর আগে মুক্তি পাওয়া এই সিনেমায় পাকিস্তানী তরুণীর সঙ্গে ভারতীয় যুবকের প্রেম দেখানোর ব্যপারটা মেনে নিতে পারেনি অনেকে। তাদের যুক্তি ছিল, শত্রুর সঙ্গে বন্ধুতা হয়, কিন্ত পাকিস্তানীদের সঙ্গে সম্ভব নয়...
সিলভার স্ক্রীনে দুই প্রজন্মের দুটো জুটি। একদিকে বলিউডের শাহেনশাহ অমিতাভ বচ্চন-হেমা মালিনী, অন্যপাশে রোমান্স কিং শাহরুখ খানের সঙ্গে প্রীতি জিনতা; ডিরেক্টরস চেয়ারে বসে থাকা সত্তরোর্ধ্ব মানুষটার নাম যশ চোপড়া- পর্দায় ভালোবাসা ফুটিয়ে তুলতে সবচেয়ে ভালো জানতেন যিনি। আরও আছেন রানী মুখার্জী; মনোজ বাজপায়ী, অনুপম খের আর বোমান ইরানীর মতো তুখোড় অভিনেতারাও শামিল হয়েছেন মিছিলে। এমন সব গুণী মানুষদের মিলনমেলা থেকে আপনি একটা মাস্টারপিস সিনেমা পাবেন না, তা কি করে হয়?
সাল দুই হাজার চার। যশ চোপড়া নতুন সিনেমা বানাবেন। রোমান্টিক ঘরানার সিনেমার জন্যেই বিখ্যাত তিনি। গল্পটা ভারত-পাকিস্তান দুই দেশকে নিয়ে। ভারতীয় বিমানবাহিনীর একজন স্কোয়াড্রন লীডার বীরপ্রতাপ সিং, আর পাকিস্তানী তরুণী জারা’র ভালোবাসার গল্পকে চিত্রনাট্যের মলাট থেকে রূপালী পর্দায় রূপ দিতে চাইছেন যশরাজ ফিল্মজের সর্বময় অধিকারী মানুষটা। এতক্ষণে সবাই বুঝে গেছেন, কোন সিনেমাটা নিয়ে কথা বলছি। হ্যা, ক্লাসিক রোমান্টিক সিনেমার খেতাব পাওয়া ‘বীর-জারা’ সিনেমাটা মুক্তি পেয়েছিল ২০০৪ সালের এই দিনে, আজ থেকে ঠিক ষোলো বছর আগে। ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে রোমান্টিকতার নতুন একটা সংজ্ঞা তৈরী করে দিয়েছিল যে সিনেমা।
সিনেমার নাম প্রথমে 'বীর-জারা' ছিল না, রাখা হয়েছিল ‘ইয়ে কাহা আ গ্যায়ে হাম’। অমিতাভ-যশ চোপড়া জুটির বিখ্যাত সিনেমা সিলসিলা’র একটি গানের আদলের রাখা হয়েছিল নামটা। পরে দুই কেন্দ্রীয় চরিত্রের নামের সঙ্গে মিলিয়ে নামকরণ করা হয় এই সিনেমার। একটা অংশে দেখানো হয়েছিল, পাকিস্তানের লাহোর থেকে ভারতের অমৃতসরের উদ্দেশ্যে শাহরুখ খান বাসে করে যাত্রা করেন, বাস্তবে তখনও লাহোর থেকে অমৃতসরের কোন বাস সার্ভিস চালু ছিল না। সিনেমাটা মুক্তির এক বছর এক মাস পরে পরীক্ষামূলকভাবে দুই দেশের মধ্যে এই রুটে বাস চলাচল শুরু হয়েছিল।
রানী মুখার্জীর করা সামিয়া সিদ্দিকী চরিত্রটা পাকিস্তানের হিউম্যান রাইটস ওয়াচ অ্যাকটিভিস্ট এবং বিখ্যাত উকিল আসমা জাহাঙ্গীরের আদলে তৈরী করা হয়েছিল। এই চরিত্রের প্রস্তাব নাকি ঐশ্বরিয়া রাইকেও দেয়া হয়েছিল, কিন্ত তিনি রাজী হননি। অনুপম খের এবং কিরন খের বাস্তবে স্বামী স্ত্রী, দুজনেই এই সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন, কিন্ত একসঙ্গে কোন দৃশ্যে দেখা যায়নি তাদের। শাহরুখ প্রীতি জিনতা জুটি বেঁধে বেশ কিছু সিনেমায় অভিনয় করেছেন, কিন্ত একমাত্র ‘বীর-জারা’তেই তাদের মিলন হয়েছিল, বাকীগুলোতে শেষ দৃশ্যে হয়তো কেউ মরে গেছেন, কিংবা তাদের বিচ্ছেদ হয়ে গেছে!
শাহরুখ খানের জেলখানার অংশের দৃশ্যগুলোর শুটিং শেষ করা হয়েছিল একদিনে। বয়স্ক সাজার জন্যে মাথায় বাড়তি উইগ পরতে হয়েছিল কিং খানকে। ‘বীর-জারা’তে শাহরুখের কস্টিউম ডিজাইনের দায়িত্ব নিয়েছিলেন করণ জোহর। দারুণ কাজ করেছেন তিনি, সেটা এই সিনেমার দর্শকেরা ভালো জানবেন। মনোজ বাজপায়ীর এই সিনেমায় অভিনয়ের কথা ছিল না, অজয় দেবগন ‘রাজা সিরাজী’ চরিত্রটা করতে রাজী না হওয়াতেই তার আগমন ঘটেছিল।
সিনেমাটোগ্রাফার অনিল মেহতাকে পরিচালক যশ চোপড়া বলে দিয়েছিলেন, আধুনিক যুগের সিনেমা হলেও, ‘বীর-জারা’তে যেন পুরনো আবহটা বজায় থাকে। ফ্ল্যাশব্যাকের দৃশ্যগুলোতে দর্শকেরা সেটি টের পেয়েছেন ভালোভাবেই। অমিতাভ বচ্চন তার লোডি উৎসবের গানটার জন্যে গুরদাস মানের নাম বলেছিলেন পরিচালকের কাছে, বিগ-বি’র মতে, তার লিপে গুরদাসের কণ্ঠই সবচেয়ে বাস্তবসম্মত মনে হয়।
১৯৭৫ সালে মারা যাওয়া মিউজিক কম্পোজার মদন মোহনের গান ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যশ চোপড়া। প্রায় ত্রিশ বছরের বেশী পুরনো গানগুলো কতটা দর্শকপ্রিয়তা পাবে- সেটা নিয়ে অনেকেরই সন্দেহ ছিল। মদন মোহনের আর্কাইভের একশোটা গান নিয়ে বসেছিলেন আদিত্য চোপড়া, পঁয়ত্রিশটা গানের মধ্যে থেকে এগারোটা গান বাবার সিনেমার জন্যে বাছাই করেছিলেন তিনি। ‘ওল্ড ইজ গোল্ড’- এই উক্তিটার সত্যতা সিনেমার গানগুলোর তুমুল জনপ্রিয়তা থেকেই বোঝা যায়।
বলিউডে তখন প্রীতি জিনতার একটা ওয়েস্টার্ন ঘরানার ইমেজ দাঁড়িয়ে গেছে, এই টাইপের রোল ছাড়া তাকে নাকি মানায় না- এমনটাই ভাবতেন পরিচালকেরা। যশ চোপড়া সেই ধারণা ভাঙতেই ‘বীর-জারা’র কেন্দ্রীয় নারী চরিত্রে কাস্ট করেছিলেন প্রীতিকে। ২০০৪ সালে এই সিনেমার বাজেট ছিল পঁচিশ কোটি রূপি, এখনকার হিসেবে যেটা প্রায় সত্তর কোটি রূপির সমান। ‘বীর-জারা’র বক্স অফিস কালেকশান ছিল প্রায় ১১২ কোটি রূপির বেশী, ২০১৭ সালে যে অঙ্কটা প্রায় তিনশো কোটিতে দাঁড়ায়। শুধু দর্শকই নয়, সমালোচকদের মনও জয় করেছিল যশ চোপড়ার এই সিনেমাটা। ফিল্মফেয়ারে সেরা সিনেমা হয়েছিল এটি, সেরা গল্প, সেরা সংলাপ এবং সেরা লিরিকের পুরস্কারও ঘরে তুলেছিল ‘বীর-জারা’।
দুর্দান্ত অভিনয়ের পরেও শাহরুখ খান এই সিনেমার জন্যে সেরা অভিনেতা হিসেবে ফিল্মফেয়ার জিততে পারেননি। ফিল্মফেয়ারের পঞ্চাশতম আসরে সেরা অভিনেতা তিনিই হয়েছিলেন, তবে সেটা আরেক সিনেমা ‘স্বদেশে’র জন্যে। এই সিনেমার সংলাপগুলো তখন তুমুল জনপ্রিয় হয়েছিল, লতা মঙ্গেশকর, উদিত নারায়ণ আর সনু নিগমের গাওয়া গানগুলো ঘুরে ফিরতো লোকের মুখে মুখে। ষোলো বছর পার হয়ে গেলেও সেসবের আবেদন কমেনি এতটুকুও!
তবে কট্টরপন্থীরা এই সিনেমার সমালোচনাতেও মেতেছিল। বিশেষ করে পাকিস্তানী তরুণীর সঙ্গে ভারতীয় যুবকের প্রেম দেখানোর ব্যপারটা মেনে নিতে পারেনি কেউ কেউ। তাদের যুক্তি ছিল, শত্রুর সঙ্গে বন্ধুতা হয়, কিন্ত পাকিস্তানীদের সঙ্গে সম্ভব নয়। আবার ভারতীয় সিনেমায় পাকিস্তানের মানুষজনকে মহান হিসেবে দেখানো হয়েছে- সেটারও নিন্দা করেছে অনেকে। তবে যশ চোপড়ার ভাষ্য ছিল- তিনি মানুষকে নিয়ে গল্প লিখেছেন, তাতে ভারতীয় বা পাকিস্তানী বিবেচনায় আনেননি। দুই দেশের ভাষা আর সংস্কৃতি মিলে যায় বলেই ভারতের পাশাপাশি পাকিস্তানের নাম এসেছে, নইলে হয়তো সেখানে চীনও থাকতে পারতো।
‘বীর-জারা’ একটা ইতিহাসের নাম। ভালোবাসা মানে তো শুধু প্রাপ্তি নয়, অপ্রাপ্তিতেও ভালোবাসা হয়, অনন্ত অপেক্ষাতেও বন্দী প্রকোষ্ঠে ভালোবাসা লুকিয়ে রয়- এই বার্তাটা যশ চোপড়া-শাহরুখ খান-প্রীতি জিনতারা আমাদের জানিয়েছেন এই সিনেমার মাধ্যমে। ভালোবাসা যেমন চিরসবুজ, মুক্তির ষোলো বছর পরেও ‘বীর-জারা’ আমাদের কাছে তেমনই নতুন, তেমনই সজীব।