বাঙালির জয়, বাঙালির ব্যর্থতা ও এক বিজ্ঞানীর গল্প!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

জীবনের ৮৬ বসন্ত পার করে এসে এই বিজ্ঞানী নিজের বই ফেরি করছেন বইমেলায়। তাকে প্রমোট করবার মতো ডাইহার্ড ফ্যানবেজ নেই। আসুন আমরাই না হয় তার হয়ে প্রচারণা চালাই।
শুরু হয়েছে তারুণ্যের আসর। অমর একুশে বইমেলা। সেখানে একজন মানুষ আপন মনে নিজের বই ফেরি করে বেড়াচ্ছেন। জীবনের ৮৬ বসন্ত পার করে এসেছেন। তবুও তিনি বয়সের ভারে ক্লান্ত হননি। বরং তার একাগ্রতায় তারুণ্যকে জয় করেছেন। মানুষটার পরিচয় দেবার আগে তার সম্পর্কে কিছুটা জেনে নেয়ার চেষ্টা করা যাক। আমাদের চেনার কথাও না তাকে। কারণ তিনি কোনো সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার নন। ফেসবুক, ইউটিউব, ইন্সটাগ্রাম কিংবা টিকটকে তার কোনো ‘শিল্পকর্ম’ নেই।
সাধাসিধে এই মানুষটা জন্মেছিলেন ১৯৩৪ সালে ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ থানার চরমধুচারিয়া গ্রামে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন শাস্ত্রে অনার্স করেন। থিসিস গ্রুপে এমএসসি ডিগ্রী লাভ করে পোস্ট এমএসসি গবেষণায় অংশগ্রহণ করেন। ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন। অতঃপর ইরানের তেহরান নিউক্লীয় বিজ্ঞান ইন্সটিটিউট থেকে পোষ্ট এমএসসি গবেষণা করেন। সুইজারল্যান্ডের ফেডারেল নিউক্লীয় ইন্সটিটিউট থেকে পোষ্ট ডক্টরাল গবেষণা সম্পন্ন করেন।
দেশে ফিরে এসে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধীনে এসিস্ট্যান্ট একজামিনার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরবর্তীতে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনে নিউক্লীয় শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের উপর দীর্ঘদিন গবেষণা করেন। ১৯৯২ সালে উক্ত সংস্থার নিউক্লিয় বিজ্ঞান ও গবেষণা ইস্টিটিউটের পরিচালক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ এগ্রিকালচার এন্ড টেকনোলজি এর রসায়ন শাস্ত্রের শিক্ষকতা করেছেন।
এখানেই শেষ নয়। তিনি একাধারে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এবং গবেষণা করেছেন প্রাক্তন সোভিয়েত রাশিয়া, পূর্ব জার্মানী, চেকোস্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, গণচীন, জাপানের মতো রাষ্ট্রগুলোতে। রিজিওনাল কো-অপারেটিভ এগ্রিমেন্ট নামক একটি দক্ষিণ এশিয় আঞ্চলিক ফোরামে দীর্ঘ ৭ বছর বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। তার নিজস্ব গবেষণার ফলাফলের উপর ভিত্তি করে দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন জার্নালে লেখা প্রকাশিত হয়েছে।
মানুষটা খুব অনায়াসে আরাম আয়েশ করে প্রবাসে থেকে যেতে পারতেন। সেখানেই বিজ্ঞানচর্চা করে কাটিয়ে দিতে পারতেন বাকীটা জীবন। যে মেধা তার ছিলো, অর্থ কিংবা খ্যাতি কোনটার অভাবই হতো না বোধ হয়। সেসব বাদ দিয়ে, শেষবেলায় এসে বইমেলায় ঘুরে ঘুরে নিজের বই বিক্রী করছেন। অথচ তার অর্জনের ধারে কাছে যাবার যোগ্যতা আমাদের অনেকেরই নেই। আর সেই মানুষটা বই হাতে আমাদের আশেপাশে ঘুরছেন, আমরা তাকে চিনতে পারছি না। এটা আমাদের ব্যর্থতা।

অমায়িক এই মানুষটা হচ্ছেন ডাঃ ফয়জুর রহমান আল সিদ্দিকী। একাধারে বিজ্ঞানী এবং স্কলার। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্বামী প্রয়াত ড. ওয়াজেদ সাহেবের সহকর্মীও ছিলেন তিনি। গতকাল অমর একুশে বইমেলায় এই মানুষটাকে দেখে রাসেল হোসেইন তার বইয়ের কথা এবং ছবি পোষ্ট করেন ফেসবুকে। সেখান থেকেই ব্যাপারটি এগিয়ে চলো টিমের নজরে আসে। নিজের লেখা বই নিয়ে এক দোকান থেকে অন্য দোকানে ঘুরছিলেন বিক্রীর জন্য। উনি শুধু বই ছাপানোর খরচটাই রাখেন, কোনো লাভ বা ব্যবসা করেন না। উনার হাতে ব্যাগভর্তি বইয়ের ভারে ক্ষয়ে যাওয়া জুতা নিয়েই দ্রুত হেঁটে হেঁটে নিজের লেখা বই ‘বাঙালির জয়, বাঙালির ব্যর্থতা’ ফেরি করছেন।
একটা সময় ছিলো যখন লেখকেরা লেখালেখির মাধ্যমেই জনপ্রিয় হতো। এখন সময়টা সোশ্যাল মিডিয়ার। সোশ্যাল মিডিয়ায় কেউ ভাইরাল কিংবা জনপ্রিয় হয়ে গেলে বইমেলায় নিজের বই প্রকাশ করাটাই এখনকার ট্রেন্ড। মেধা আছে কি নেই সেটা বিবেচ্য নয়, জনপ্রিয়তাই এখন বই প্রকাশের মাপকাঠি। প্রতিভা কিংবা মেধার দরকার নেই। ভাইরাল হলেই হলো আরকি! এই অনলাইন প্রচারণার ভিড়ে একজন ভেটেরান নিজের বই ফেরি করে বেড়াচ্ছেন। তাকে প্রমোট করবার মতো ডাইহার্ড ফ্যানবেজ কিংবা ফলোইং নেই। আসুন আমরাই না হয় তার হয়ে প্রচারণা চালাই। এই সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের শক্তিটা কাজে লাগাই।
চলমান অমর একুশে বইমেলার দ্বিতীয় প্যাভিলিয়ন পুঠিনিলয় এ তার বই পাওয়া যাবে। বইটির নাম ‘বাঙালির জয়, বাঙালির ব্যর্থতা’। আমরা যারা বইমেলায় যাই, সম্ভব হলে তার বইয়ের একটি কপি কিনি। সেটা সম্ভব না হলে শেয়ারের মাধ্যমে তার বইয়ের বার্তা ছড়িয়ে দিই। আসুন ফয়জুর সাহেবের বইয়ের প্রচারণা আমি, আপনি, আমরা সবাই মিলেই করি। বাঙালির জয় হোক, বাঙালির ব্যর্থতার গ্লানি মুছে।