
একটা মেয়ে ধর্ষণের শিকার হলে আমরা বলি, 'নিশ্চয়ই মেয়েটির পোশাকে সমস্যা ছিল।' কেউ রাত দুইটার সময় রাস্তায় খুন হলে আমাদের মন্তব্য হয়- 'অত রাতে সে রাস্তায় কী করছিল?' কিন্ত কেন আমরা এভাবে ভিক্টিমের দিকেই বারবার আঙুল তুলি?
কোনো মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছে। "নিশ্চয়ই মেয়েটির পোশাকে সমস্যা ছিল।"
কারো পকেট থেকে মানিব্যাগ খোয়া গেছে। "হয়তো লোকটি মানিব্যাগ ঠিকভাবে পকেটে রাখেনি, কিংবা ভিড়ের মাঝে অসাবধানে চলাচল করছিল।"
কোনো ব্যক্তি রাত দুইটার সময় রাস্তায় খুন হয়েছে। "অত রাতে সে রাস্তায় কী করছিল?"
তিনটি উদাহরণ তিন রকমের। কিন্তু এদের মাঝে একটি সাদৃশ্য রয়েছে। সেটি হলো, এই তিন ঘটনার ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীর দিকে আঙ্গুল তোলা হচ্ছে। তাদের দুরাবস্থার জন্য প্রত্যক্ষভাবে দায়ী যারা, অর্থাৎ যৌন নিপীড়ক, পকেটমার বা খুনি, সেই অপরাধীদেরকে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানানোর বদলে ভুক্তভোগীদেরকেই দায়ী করা হচ্ছে।
আমরা প্রায় সকলেই জানি, এ ধরনের প্রবণতাকে বলা হয় ভিকটিম ব্লেমিং। তবে মানুষ ভিকটিম ব্লেমিং কেন করে, সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আরেকটি বিষয়ও সামনে চলে আসে। সেটি হলো, জাস্ট ওয়ার্ল্ড ফেনোমেনন।
জাস্ট ওয়ার্ল্ড ফেনোমেনন বলতে মূলত মানুষের সেই প্রবণতাকে নির্দেশ করা হয়, যার ফলে তারা বিশ্বাস করে যে এই পৃথিবীটা মূলত ন্যায়পরায়ণ, লোকের সাথে তা-ই হয় যা তাদের প্রাপ্য। অর্থাৎ এ ফেনোমেননের মূল কথা হলো, আপনার সাথে তা-ই হবে, যা আপনি ডিজার্ভ করেন।

এবং যেহেতু এই পৃথিবীতে সবার সাথে শুধু ভালোই হয় না, বরং অনেক সময় খারাপও হয়, সেই খারাপগুলোকে যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে ন্যায্যতা প্রদান করতে গিয়ে বলা হয়ে থাকে, ওই খারাপটা আসলে একজন ব্যক্তির নিজেরই কর্মফল।
কিছু কিছু মানুষের এই বিশেষ প্রবণতার একটি ধ্রুপদী উদাহরণ রয়েছে বাইবেলের 'বুক অভ জব'-এ। সেখানে দেখা যায় জব একের পর এক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে, এবং এক পর্যায়ে তার এক প্রাক্তন বন্ধু তাকে বলছে, সে নিশ্চয়ই খুব বাজে কোনো কাজ করেছে, যার ফলস্বরূপ তার ভাগ্যে এমন দুর্দশা নেমে এসেছে।
এমনকি বর্তমান সময়েও এই প্রবণতা খুব বেশি দেখা যায় যৌন নিপীড়নের শিকার ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে, যেমনটি আগেই বলেছি; কিংবা দরিদ্রদের ক্ষেত্রে, যাদের অর্থনৈতিক দুরাবস্থার জন্য ধনীরা তাদের দিকেই আঙ্গুল তোলে। বলে, "ওরা দরিদ্র কেননা ওরা নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করেনি।"
এখন প্রশ্ন হলো, কেন কিছু মানুষের মধ্যে জাস্ট ওয়ার্ল্ড ফেনোমেনন দেখা যায়?
প্রথমত, মানুষের মধ্যে ভয় কাজ করা। তারা এটি ভাবতে ভয় পায় যে তাদের সাথেও খারাপ কোনো ঘটনা ঘটতে পারে, বিশেষত তারাও কোনো সহিংসতার শিকার হতে পারে। মন থেকে এরূপ ভীতি দূরীকরণের সহজ পন্থা হিসেবে তারা বেছে নেয় ভুক্তভোগীকে দোষ দেয়াকে। বারবার ভুল কথা বললে বা ভাবলে একসময় সেটিকেও সত্য বলে মনে হয়। সে সুযোগটিকেই তারা কাজে লাগায়। বারবার ভুক্তভোগীকে দায়ী করে এক পর্যায়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে তারা, এবং অবচেতন মনে ভাবে, "যাক বাবা, আমি তো এমন নই! তাহলে আমার সাথে কোনো খারাপ ঘটনা ঘটবে না!"
দ্বিতীয়ত, অনেক মানুষই চায় দায় এড়াতে। তারা ভয় পায়, অন্য কারো সাথে হওয়া খারাপ ঘটনার দায় কিছুটা তাদের উপরও বর্তাতে পারে। যেমন কোনো ব্যক্তি যদি ধনী হয় আর তার পাশের মানুষটি হয় গরিব, তখন ধনী ব্যক্তিটি ভাবে যে হয়তো তাকেও দায়ী করা হবে যে কেন সে গরিব লোকটিকে সাহায্য করল না, কিংবা আরো বৃহৎ অর্থে, সে একটি ত্রুটিপূর্ণ সমাজব্যবস্থাকে মেনে নিয়ে সেটির সদ্ব্যবহার করেছে বলেই অন্য আরেকজন মানুষ সহায়-সম্বলহীন অবস্থায় পড়ে আছে। এই দায় যেন কোনোভাবেই নিজের দিকে না আসে, এবং ভবিষ্যতে নিজেকে কোনোপ্রকার অপরাধবোধেও ভুগতে না হয়, সেজন্য সে আগেভাগে ভুক্তভোগীকে অভিযুক্ত করে বসে।
তৃতীয়ত, অনেক মানুষ চায় বাস্তবতা থেকে পালাতে। অবচেতন মনে তারা ভাবে, যদি সমাজ বা পৃথিবীকে পুরোপুরি ন্যায্য ও অপরাধ-দুর্নীতিমুক্ত করে তোলার আশা করা হয়, তাহলে দোষী সবাইকে শাস্তি দিতে হবে, কঠোর আইনকানুন প্রয়োগ করতে হবে, যা কোনোভাবেই বাস্তবসম্মত নয়। পৃথিবীর দশা কখনোই এতটা ইউটোপিয়ান হবে না যে সবকিছু যথাযথভাবে চলবে, কোথাও কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকবে না। কিন্তু যারা পার্থিব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের দেখা পেয়েছে, তারা চায় না এসব রূঢ় বাস্তবতাকে মেনে নিতে। কারণ তাহলে তাদের সুখী জীবনাচরণে ব্যাঘাত ঘটবে। এজন্য তারা কল্পিত সুখের জগতেই বাস করতে চায়, আর সে লক্ষ্যে দুঃখী সকলের দুঃখের জন্য তাদেরকেই দোষারোপ করে।

এদিকে জাস্ট ওয়ার্ল্ড ফেনোমেনন অনুযায়ী কিছু কিছু মানুষ কারো সাথে ভালো কিছু হওয়াকেও তার সৎ কর্মফল হিসেবে বিবেচনা করে। যেমন কেউ যদি অর্থনৈতিকভাবে প্রভূত উন্নতি করে, এর পেছনে তারা ওই লোকটির কঠোর পরিশ্রমকেই একমাত্র কারণ হিসেবে খুঁজে পায়। এ কথা সত্যি যে পৃথিবীতে অনেকে নিজ কর্মগুণেই সাফল্য পায়, ধন-সম্পদের মালিক হয়। কিন্তু যারা ঢালাওভাবে সব সফল ব্যক্তির সফলতাকেই 'ওয়েল ডিজার্ভড' মনে করে, আদতে তাদের মধ্যেও এক ধরনের বায়াস কাজ করে। সম্ভবত তারা নিজেরা কোনো অসৎ পথে সাফল্য পেয়েছে বা পেতে চলেছে, তাই তাদের সেই সাফল্য যেন প্রশ্নবিদ্ধ না হয় সেজন্য নিজেরা আগেভাগেই ইতিবাচকতার মুখোশ পরে থাকে।
মজার ব্যাপার হলো, মনোবিজ্ঞানীদের মতে জাস্ট ওয়ার্ল্ড ফেনোমেনন সবসময় যে খারাপ ব্যাপার, তা-ও নয়। কেননা অন্য অনেক কগনিটিভ বায়াসের মতো, এই ফেনোমেননও অনেক মানুষের আত্মবিশ্বাস ধরে রাখে, তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা বাড়ায়, এবং সম্ভাব্য সবচেয়ে দুঃসময়ও তাদের আশাবাদী থাকতে সাহায্য করে।
কিন্তু অবশ্যই, এ ফেনোমেননের উপকারিতার চেয়ে অপকারিতাই বেশি। প্রধানত, এর কারণে মানুষ তাদের সহানুভূতি ও সংবেদনশীলতা হারায়। তারা অন্যের দুঃখ-দুর্দশাকে বিন্দুমাত্র অনুভব করতে পারে না, বরং সেই দুঃখ-দুর্দশাকে প্রশ্নবিদ্ধ ও কটাক্ষ করে অসহায় মানুষদের দুরাবস্থাকে আরো শতগুণে বাড়িয়ে দেয়।
এ ধরনের ফেনোমেননের চর্চা ক্রমশ মানুষকে বিবেকশূন্য করে তোলে, তাদের মধ্যে সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স জাগিয়ে তোলে। সর্বোপরি এ ফেনোমেনন মানুষকে করে তোলে প্রচণ্ড রকমের জাজমেন্টাল ও আত্মকেন্দ্রিক। নিজের (এবং নিজের পরিবার, আপনজনের) বাইরে জগতের আর কারো দুঃখ-কষ্টই তাদেরকে ব্যথিত করে না। বরং অন্যের ক্ষতকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দগদগে ঘা করে তোলার মাঝে তারা বিকৃত আনন্দের উৎস খুঁজে পায়।