'শীশা' বনাম 'ভিকটিম'- নকলের অভিযোগ আসলে কতটা সত্যি?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
অভিযোগ উঠেছে ঈদে তুমুল প্রশংসিত আশফাক নিপুণের 'ভিকটিম' টেলিফিল্মটি নাকি একটি বিদেশি চলচ্চিত্রের নকল। কেউ কেউ আবার একটু রয়েসয়ে বলছেন, নকল নয় ঠিক, তবে মূল থিমটা অনুপ্রাণিত। আসলেই কি তাই?
সময়ের অন্যতম সেরা নির্মাতা একটি টেলিফিল্ম বানিয়েছেন, এবং সেই টেলিফিল্মটি দর্শক-সমালোচক সর্বমহলে দারুণ প্রশংসিতও হয়েছে। অনেকেরই ধারণা, এই টেলিফিল্মটি দেশের টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রিকে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখবে। আর এই টেলিফিল্মটির মাধ্যমে ওই নির্মাতার ভাবমূর্তিও পূর্বাপেক্ষা উজ্জ্বল হয়েছে। সকলেই বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, তিনি ভবিষ্যতে আরো অসাধারণ সব কাজ উপহার দেবেন।
এই পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই ঘনিয়ে এলো ঘোর অমানিশা। অভিযোগ উঠল, প্রশংসিত ওই টেলিফিল্মটি নাকি প্রায় সাড়ে তিন দশক আগে মুক্তিপ্রাপ্ত একটি বিদেশি চলচ্চিত্রের নকল। কেউ কেউ আবার একটু রয়েসয়ে বলতে লাগল, নকল নয় ঠিক, তবে মূল থিমটা অনুপ্রাণিত। এভাবেই, এতদিন যে টেলিফিল্মটি নিয়ে সবাই হৈ হৈ করেছে, সেটির নামের পাশে কেমন একটা কালিমা লেপ্টে গেল। ওই যে কথায় আছে না, চাঁদের গায়েও কলঙ্ক থাকে, এ যেন ঠিক তেমনই!
কিন্তু সমস্যা হলো, অভিযোগ ওঠা মানেই তো সেটি সত্য, তা নয়। অভিযোগটি ভুলও হতে পারে। প্রফেসর ডাম্বলডোর যেমন বলেছিলেন, "Innocent until proven guilty, Severus!" কিন্তু সৃজনশীল অঙ্গনে এই ধরনের অভিযোগ সঠিক বলে প্রমাণ করা যেমন কঠিন, তেমনই কঠিন কাউকে পুরোপুরি নির্দোষ হিসেবে মেনে নেয়া। সব মিলিয়ে প্রচণ্ড গোলমেলে পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো।
যদি নির্মাতা আসলেই অন্য কোনো জায়গা থেকে টেলিফিল্মটির কাহিনী নকল করে বা অনুপ্রেরণা নিয়ে না থাকেন, তবুও যে তার নামে এই অভিযোগ উঠল, সেটি তার জন্য খুব বড় ধরনের অবিচার। এত অসাধারণ একটি কাজ করার পরও, কিছু মানুষ ঠিকই মনে করবে তিনি নকল করেছেন। ফলে তার প্রাপ্য সবটুকু সম্মান থেকে তিনি বঞ্চিত হবেন।
আবার যদি আসলেই তিনি নকল করে থাকেন বা অনুপ্রেরণা নিয়ে থাকেন, অথচ দর্শকের থেকে সেটি গোপন করে যান, তাহলে অবিচারটা অনেকাংশে দর্শকের সাথেও হয়েছে। কেননা দর্শকদের একাংশ তো বিশ্বাস করেছে এবং এখনও করছে যে টেলিফিল্মটির প্রকৃত কারিগর ওই নির্মাতাই। সেই তথ্য যদি মিথ্যা হয়ে থাকে, তাহলে তো ওই সহজ-সরল দর্শকদের সাথে একপ্রকার ধোঁকা দেয়া হয়ে যায়, তাই না?
এদিকে অবিচার হতে পারে সেই চলচ্চিত্রের পরিচালক ও কাহিনীকারের সাথেও, যদি আসলেই তাদের সাড়ে তিন দশক আগের চলচ্চিত্রের কাহিনী নিয়ে বর্তমান সময়ে একটি সাড়া জাগানো টেলিফিল্ম নির্মিত হয়, কিন্তু সেখানে তাদের নামোল্লেখ করা না হয়, তাদেরকে তাদের প্রাপ্য কৃতিত্বের ভাগিদার করা না হয়।
অর্থাৎ, যতক্ষণ পর্যন্ত প্রকৃত সত্যটা সকলের সামনে উন্মোচিত না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা কেউই জানতে পারব না, এখানে ভিকটিমটা আসলে কে, সাম্প্রতিককালে মুক্তি পাওয়া টেলিফিল্মটির নির্মাতা, নাকি প্রায় সাড়ে তিন দশক আগে মুক্তি পাওয়া চলচ্চিত্রটির কাহিনীকার ও পরিচালক। তবে এই দুই পক্ষের ভিতর যে পক্ষই ভিকটিম হয়ে থাকুন না কেন, তৃতীয় একটি পক্ষ কিন্তু সবসময়ই ভিকটিম থেকে যাবে। সেই পক্ষটি হলো সাধারণ দর্শক। যদি আসলেই এখানে কারো কোনো দোষ না থাকে, গোটা বিষয়টিই কাকতালীয় হয়ে থাকে, তবু এই যে সাধারণ দর্শকের মনে একটা সন্দেহ ঢুকে গেল, এই সন্দেহের বীজ তো সারাজীবন তাদেরকে বয়ে বেড়াতে হবে। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তারা যেকোনো একটিকে নিশ্চিত সত্য বলে ধরে নিতে পারবে না।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এরকম একটি কাহিনী নিয়ে 'ভিকটিম ২' নামের টেলিফিল্ম বানানো যেতেই পারে!
তবে সে যা-ই হোক, 'ভিকটিম'-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠার পর আমি বেশ অনেকটা সময় নিয়েই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম 'শীশা' (১৯৮৬) চলচ্চিত্রটি। এটির পরিচালক বাসু চ্যাটার্জী, আর কাহিনী শংকরের। মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন মিঠুন চক্রবর্তী এবং মুনমুন সেন।
এ কথা অনস্বীকার্য যে 'শীশা' এবং 'ভিকটিম' এই দুইয়ের মধ্যেই বেশ কিছু মিল রয়েছে। যেমন: দুই জায়গাতেই অফিসের শীর্ষস্থানীয় একজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি কিংবা শ্লীলতাহানির অভিযোগ উঠেছে। দুই জায়গাতেই অভিযোগটি মিথ্যা হবার সম্ভাবনা রয়েছে, যার পেছনে একটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে অভিযুক্তের প্রতি অভিযোগকারীর ব্যক্তিগত আক্রোশ, কিংবা অন্য কারো দ্বারা প্ররোচিত হওয়া। দুই জায়গাতেই অভিযুক্তের স্ত্রীর মনের উপর দিয়ে বিশাল ঝড় বয়ে যায়। এতদিনের চেনা মানুষটির ব্যাপারে এইসব শোনার পর তারা দিশেহারা হয়ে পড়ে। একদিকে স্বামীর প্রতি বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে দুলতে থাকে, আবার নিজেরা নারী হওয়ার দরুণ আরেকজন নারীকে পুরোপুরি অবিশ্বাসও করতে পারে না। দুই জায়গাতেই একজন উকিল বন্ধুকে দেখা যায় যারা কিছুটা পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা পোষণ করে, এবং দাবি করে অভিযুক্তকে ফাঁসানো হয়ে থাকতে পারে। দুই জায়গাতেই অভিযুক্তের আশেপাশের মানুষজন কানাঘুঁষা করতে থাকে, অভিযুক্তের জীবনকে বিষিয়ে দিতে চায়। দুই জায়গাতেই অভিযোগ খারিজ হয়ে যায় পর্যাপ্ত যুক্তি-প্রমাণের অভাবে। দুই জায়গাতেই অনেকে উল্টো অভিযোগকারীর দিকে আঙ্গুল তোলে।
কিন্তু এবার দেখা যাক অমিল কোথায়। 'শীশা' এবং 'ভিকটিম' এর উদ্দেশ্যের মাঝেই সবচেয়ে বড় অমিল। 'শীশা' চলচ্চিত্রে শেষ পর্যন্ত এই বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে যে একজন অপরাধী যতই সমাজের কাছে নির্দোষ হিসেবে প্রমাণিত হোক না কেন, নিজের মনের আয়না তাকে নিজের সঠিক প্রতিবিম্বই দেখায়। ফলে নিজের বিবেকের তাড়না থেকে তার পক্ষে বাঁচা অসম্ভব। সারাজীবন তাকে অনুতাপের অনলে জ্বলেপুড়ে ছারখার হতে হয়। অন্যদিকে 'ভিকটিম' টেলিফিল্মটির শেষটা তো একেবারেই ওপেন এন্ডেড। অভিযুক্ত আসলেই দোষী কি নির্দোষ, তা নির্মাতা নিজে থেকে সরাসরি দেখাননি। তিনি বিষয়টি দর্শকের উপর ছেড়ে দিয়েছেন। বরং জোর দিয়েছেন গোটা ঘটনায় ভুক্তভোগী কে, তার উপর। ফলে আমরা দেখতে পাই, অভিযুক্তের স্ত্রী সবসময়ই ভুক্তভোগী, তা তার স্বামী দোষীই হোক বা নির্দোষ, অভিযোগকারীর দাবি সত্যিই হোক বা মিথ্যা।
এবার আসা যাক 'শীশা' ও 'ভিকটিম' এর মধ্যকার সাদৃশ্যগুলোর কারণ কী হতে পারে। আপনি যদি ধরেই নেন 'শীশা' থেকে নকল করে বা অনুপ্রেরণা নিয়ে 'ভিকটিম' বানানো হয়েছে, তাহলে তো আপনি আর যুক্তি-তর্কের কোনো জায়গাই রাখছেন না। কিন্তু যদি আপনি আপনার যুক্তিবাদী মনকে আরেকটা প্রশস্ত করেন, তাহলে 'ভিকটিম' এর ঘটনাবলিকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করা যায়।
আমরা প্রায় সকলেই জানি, কিংবা বুঝতে পেরেছি, 'ভিকটিম' এর কাহিনী হ্যাশট্যাগ মি টু মুভমেন্টের প্রেক্ষাপটে গড়ে উঠেছে। তো, সাম্প্রতিক সময়ের এই মুভমেন্টে কিন্তু এই ধরনের ঘটনাবলিই দেখা গেছে যে কোনো বড়, নামজাঁদা, সমাজের চোখে সম্মানিত ব্যক্তির নামে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠছে। পরবর্তীতে আরেকদল বলেছে, অভিযোগকারী এতদিন কই ছিল, আগে কেন সে মুখ খোলেনি? আর খুব স্বাভাবিকভাবেই অভিযুক্ত ব্যক্তি নিজের আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য দাবি করে, সে নির্দোষ। সমাজের কাছে তাকে খাটো করতে, তার পেশাদারী প্রতিদ্বন্দ্বীরা তাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করেছে। অথবা অভিযোগকারী ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে এমনটি করার চেষ্টা করছে। অর্থাৎ, বাস্তবে আমাদের চোখের সামনে আমরা যা দেখি, সেটিই দেখানো হয়েছে 'ভিকটিম' টেলিফিল্মে। এবং যেহেতু বাস্তবতা সবসময়ই এমন হয়, তাই 'শীশা' চলচ্চিত্রেও ঠিক একই ধরনের ঘটনার অবতারণা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। বাস্তবতাই দুইটি পৃথক কাহিনীতে প্রায় একইভাবে প্রতিফলিত হতেই পারে। তার মানেই এটি নয় যে একটি অন্যটির থেকে নকল বা অনুপ্রাণিত।
আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, 'শীশা' এবং 'ভিকটিম' দুইটিতেই তাদের নামকরণের সার্থকতা রক্ষিত হয়েছে, এবং দুটির ইন্টারপ্রিটেশনই একেবারে ভিন্ন। ফলে দুইটিই দারুণ উপভোগ্য, এবং চিন্তা উদ্রেককারী। একজন চিন্তাশীল, মননশীল, রুচিসম্মত কাজের গুণগ্রাহী দর্শক হিসেবে সকলেই 'শীশা' ও 'ভিকটিম' দেখতে পারেন, এবং দেখার পর নিজ নিজ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেন। অন্যের কথায় প্রভাবিত হওয়ার পরিবর্তে, নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়াটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
বাসু চ্যাটার্জী আজ আর আমাদের মাঝে নেই। এই বছরের ৪ জুন তিনি পরলোকগমন করেছেন। তার প্রতি রইল শ্রদ্ধাঞ্জলী। তার পরিচালিত 'ব্যোমকেশ বক্সী' চিরদিন আমাদের স্মৃতিতে অম্লান হয়ে রইবে। এছাড়া 'হঠাৎ বৃষ্টি'-র কথাও কোনো বাংলা চলচ্চিত্রপ্রেমীর পক্ষে ভোলা সম্ভব নয়। মণিশংকর মুখোপাধ্যায়ও বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠতম সাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম। তার 'চৌরঙ্গী' পাঠের অভিজ্ঞতা ছিল অসাধারণ। এছাড়াও তার 'কত অজানা রে' কিংবা 'চরণ ছুঁয়ে যাই' আমার পড়া শ্রেষ্ঠ বইগুলোর তালিকায় রয়েছে। দুঃখজনকভাবে যে 'মান সম্মান' অবলম্বনে 'শীশা' নির্মিত, সেটি পড়া হয়নি। তবে ভুলে গেলে চলবে না, স্বয়ং সত্যজিৎ রায়ও কিন্তু তার উপন্যাস অবলম্বনে 'জন অরণ্য', 'সীমাবদ্ধ'-এর মতো কালজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। সুতরাং তার অবস্থানও যে ঠিক কোথায়, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
বাসু চ্যাটার্জী কিংবা শংকরের মতো রথী-মহারথীদের তুলনায় আশফাক নিপুণের পথচলা তো সবে শুরু হয়েছে। তার এখনো অনেকটা পথ বেরোনো বাকি। তিনি যদি সত্যিই এই দুই কিংবদন্তীর কাজ থেকে অনুপ্রেরণা নিতেন, তাহলে তা তিনি স্বীকার করতেন বলে আমার বিশ্বাস। যেহেতু তিনি বলছেন এই চলচ্চিত্রটি আগে তিনি কখনো দেখেনই নি, আমি ব্যক্তিগতভাবে সেটিকেই সত্য বলে ধরে নিচ্ছি। তা সে যা-ই হোক, মানুষ হিসেবে আশফাক নিপুণ কেমন, তা তো আর আমি জানি না। তাই নিশ্চিত করে কিছু বলা উচিতও না। আমি শুধু প্রত্যাশা করি একজন সুনির্মাতা হিসেবে তিনি ভবিষ্যতে 'ইতি, মা' কিংবা 'ভিকটিম' এর মতো কাজ আরো বেশি বেশি উপহার দেবেন। আমি চাই, নিজের মনের আয়নায় তিনি সবসময় সৎ থাকবেন। এবং আমি চাই না, তার নিজের যা কৃতিত্ব, সেটি যেন তার থেকে অপহৃত না হয়, তাকে যেন ভিকটিমে পরিণত হতে না হয়।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন