এ সময়ের অন্যতম মেধাবী নির্মাতা আশফাক নিপুনের এই টেলিফিল্মটি দর্শককে ভাবাবে নানা দিক থেকেই। সে সাথে 'বাংলাদেশি নাটকে যে কাহিনীর গভীরতা থাকে না' এই বক্রোক্তিরও একটি জবাব পাওয়া যাবে!

কেউ যদি মনে করে থাকেন বাংলাদেশি নাটক বা টেলিফিল্মে কাহিনীর গভীরতা থাকে না, চরিত্রের গভীরতা থাকে না, নির্মাতার মুনশিয়ানার ছাপ থাকে না, নাটক শেষে দর্শকের নিজের ভাবার বা চিন্তা করার জায়গা থাকে না, তাহলে তার ভুল ভাঙানোর জন্য আমি 'ভিকটিম' টেলিফিল্মটি সাজেস্ট করব। এই টেলিফিল্মটির গল্প, চিত্রনাট্য ও পরিচালনা সময়ের সবচেয়ে মেধাবী নির্মাতাদের একজন আশফাক নিপুনের। 

টেলিফিল্মের কাহিনী আপাতদৃষ্টিতে খুব সোজাসাপটা। স্বামী, মেয়ে আর শ্বশুর-শাশুড়িকে নিয়ে অপি করিমের সুখের সংসার। স্বামী আফরান নিশোর সাথেও তার চমৎকার রসায়ন। দুজনেই তারা কর্মজীবী, এবং কাজের ব্যাপারে কারো সাথে কারো ইগোর দ্বন্দ্বও নেই। বরং পারস্পরিক সহযোগিতা ও সমর্থনই দেখা যায়। সহজ কথায় তারা একটি পারফেক্ট কাপল। 

কিন্তু এই পারফেক্ট কাপলের সম্পর্কেই একটি বিশাল বড় ধাক্কা হয়ে আসে অফিসে নিশোর বিরুদ্ধে তার এক প্রাক্তন নারী সহকর্মী সাফা কবির কর্তৃক সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের অভিযোগ। সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয় তাকে, আটকে যায় প্রমোশন। বসানো হয় তদন্ত কমিটি। এদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুরু হয় এই ঘটনা নিয়ে লেখালেখি। সব মিলিয়ে নিশো-অপির মধ্যকার সম্পর্ক এবং তাদের নিজ নিজ ব্যক্তিগত জীবন, সবখানেই দানা বাঁধে শুধু অশান্তি আর অস্থিরতা, অবিশ্বাসের দোলাচল। 

এখন প্রশ্ন হলো, সামগ্রিকভাবে এই ঘটনায় ভিকটিম কে? সাফা, যে সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের অভিযোগ তুলেছে? কিংবা নিশো, যে দাবি করছে সে নির্দোষ, তাকে ষড়যন্ত্র করে ফাঁসানো হয়েছে? নাকি ভিকটিম একেবারে ভিন্ন কেউ?

একটি কথা অনস্বীকার্য যে বাংলাদেশ অধিকাংশ নাটক-সিনেমাতেই চরিত্রগুলো হয় বড্ড বেশি স্থূল। তারা হয় পুরোপুরি সাদা, নয়ত পুরোপুরি কালো। কোনো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে চরিত্রদের যে মনস্তাত্ত্বিক যাত্রা, সেটির উপস্থাপন বাংলাদেশি নাটক-সিনেমায় দেখা যায় না বললেই চলে। কিন্তু 'ভিকটিম' হলো সেই বিরলতম কাজগুলোর একটি, যেখানে এই মনস্তাত্ত্বিক যাত্রাকে সুনিপুনভাবে তুলে ধরা হয়েছে। 

এই টেলিফিল্মের মূল শক্তি হলো এর চিত্রনাট্য, সংলাপ আর পরিচালনা। চিত্রনাট্য এমনভাবে সাজানো হয়েছে যে শেষ মিনিট অবধি দর্শকের মনে প্রশ্ন থাকবে। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে এটি কোনো সাসপেন্স থ্রিলারের চেয়ে কম নয়। আবার সংলাপগুলো এতটা বাস্তবসম্মত যে, সেগুলোর মাধ্যমেই দর্শক বাস্তবতার সাথে যোগসূত্র স্থাপন করতে পারে, দৃশ্যমান ঘটনার পক্ষে-বিপক্ষে দুই দিকেরই অবস্থান জানতে পারে। যেমন একটি দৃশ্যে অপি করিমকে তার এক বন্ধু বলে, সে নিজে একজন নারী ও কর্মজীবী হওয়ায় বায়াসড আচরণ করছে। জবাবে অপি বলে, তার বন্ধুটিও একজন পুরুষ হওয়ায় বায়াসড আচরণ করছে, যদিও মুখে সে ঠিকই নিরপেক্ষতার বুলি আউড়াচ্ছে।

এছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে মি টু মুভমেন্টের সুবাদে এই ধরনের অভিযোগের পর কিছু সাধারণ প্রতিক্রিয়া দেখা যায়: "মেয়েটা এতদিন চুপ করে ছিল কেন? এখন হঠাৎ এটা নিয়ে মুখ খুলল কেন? সে কি কারো প্ররোচনায় এই কাজ করছে?" এই প্রসঙ্গগুলোও উঠে এসেছে সংলাপের মাধ্যমে, এবং সেই সংলাপগুলোই এত প্রভাবশালী যে, তারা সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে কাহিনীকে। 

উঠে এসেছে এরকম একটি অভিযোগের পর অভিযুক্ত ও তার পরিবারের মানুষদের জীবনে নেমে আসা পরিবর্তনগুলোর কথাও। কীভাবে তাদেরকে অনলাইন কিংবা অফলাইন সর্বত্র মানুষের প্রশ্ন, বক্রোক্তি, কানাঘুঁষার সম্মুখীন হতে হয়, এবং সেগুলো কীভাবে তাদের দৈনন্দিন জীবনকে বিষিয়ে দেয়, তা দেখানো হয়েছে খুব আন্তরিকতার সাথে। তবে গোটা কাহিনীর টার্নিং পয়েন্ট নিঃসন্দেহে অপির সাথে তার মায়ের কথোপকথনের দৃশ্যটি, যা দর্শকের সামনে ঘটনাটির একদম নতুন একটি অ্যাঙ্গেল তুলে ধরে। 

যে বিশেষ দৃশ্যটির কথা বললাম, সেখানে অপির অভিনয় অসাধারণের চেয়েও বেশি কিছু ছিল। যে 'র ইমোশন'-এর বহিঃপ্রকাশ তিনি ওই দৃশ্যে ঘটিয়েছেন, তা এই টেলিফিল্মের বিষয়বস্তুকে প্রতিষ্ঠিত করতে খুবই জরুরি ছিল। এবং এরপর থেকে প্রতিটি দৃশ্যই যেন একটি রোলারকোস্টার রাইডের অভিজ্ঞতা দেয় দর্শককে। একাধারে যেমন তাদেরকে পর্দায় ঘটে চলা ঘটনায় মনোনিবেশ করতে হয়, আবার নিজেদের মনে মনেও নানা হিসাব-নিকাশ মিলাতে হয়।

এই টেলিফিল্মের পরিচালনায় নন লিনিয়ার স্টাইলটিও যথাযথ মনে হয়েছে। সাধারণত এই জায়গাটিতে বাংলাদেশি নির্মাতাদের যথেষ্ট কাঁচা মনে হয়। কিন্তু আশফাক নিপুনের কাজে তা মনে হয়নি। বর্তমান ঘটনাবলির মাঝে মাঝে পুরনো ফ্ল্যাশব্যাক এসেছে, এবং সেগুলোর ফলে কাহিনী একবারের জন্যও ঝুলে পড়েনি বা একঘেয়ে লাগেনি। বরং বর্তমান নিশোর সাথে অতীতের নিশোর বৈসাদৃশ্যগুলো এত সুন্দরভাবে দেখানো হয়েছে যে, দর্শকমনে মুগ্ধতা জন্মাতে বাধ্য। 

এখানে পরিচালকের পাশাপাশি প্রশংসার দাবিদার নিশোও। দর্শককে যেহেতু জানতে দেয়া যাবে না সে দোষী না নির্দোষ, কিন্তু ঘটনাগুলোকে যথাসম্ভব ন্যাচারাল রাখতে হবে, তাই এসব ক্ষেত্রে তার শরীরের ভাষা, চোখের ভাষা, মুখের অভিব্যক্তি ইত্যাদি অত্যন্ত জরুরি ছিল। দর্শককে সরাসরি কিছু জানিয়ে দেয়ার পরিবর্তে সূক্ষ্ম চরিত্রায়নের কাজটি যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং ছিল তার জন্য। পরিচালক যেমন সেটি তার থেকে বের করে আনতে পেরেছেন, তেমনই তিনি নিজেও নিজের সেরাটা দিয়েছেন। 

অপি করিমের অভিনয় নিয়ে তো আগেই বলেছি। তার বর্তমান সময়ের মনস্তাত্ত্বিক যাত্রাটা ছিল এই টেলিফিল্মের প্রাণ। তিনি দারুণ কাজ করেছেন। নিশোও তা-ই। এছাড়া সাফা কবির, আল মনসুর, শিল্পি সরকার অপু থেকে শুরু করে শিশু শিল্পী আরিয়া আরিত্রা, প্রত্যেকেই নিজ নিজ ভূমিকায় চমৎকার অভিনয় করেছেন।

এই টেলিফিল্মের শেষাংশটা অনবদ্য ছিল। এন্ড ক্রেডিট শুরু হওয়া মাত্রই দর্শকের পক্ষে টেলিফিল্মটির কথা ভুলে যাওয়া সম্ভব না। এর রেশ থাকবে বহুক্ষণ। মননশীল দর্শকের মনে চিন্তার ঝড়ও তুলবে। তবে নির্মম সত্যি এটিও যে, এই ধরনের কাহিনী হজম করা কিংবা সূক্ষ্ম বিষয়গুলোকে নিজেদের মতো করে বুঝে নেয়ার জন্য যে ম্যাচিউরিটি প্রয়োজন, আমাদের দেশের সিংহভাগ দর্শকেরই তা নেই। 

ভিক্টিম টেলিফিল্মে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বই বেশ প্রকট হয়ে উঠেছে   

ইউটিউবের কমেন্টগুলোতে একবার চোখ বোলালেই দেখা যাবে, শেষটা অনেকেরই পছন্দ হয়নি। কারণ স্থূলভাবে মূল ঘটনাটি যে খোলাসা করা হয়নি! অর্থাৎ ভিকটিম আসলে কে, কিংবা এই টেলিফিল্মের মাধ্যমে আসলে কী বার্তা দেয়া হলো, সেসব সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য নিজেদের মাথা খাটাতে তারা নারাজ। এমন অলস মস্তিষ্কের দর্শক নেহাত কম নয়। তবে বিপরীতে এই ধরনের গভীর কাজকে গ্রহণ করতে পারার মতো দর্শকও একেবারে যে নেই, তা নয়। আশফাক নিপুনের মতো নির্মাতারা যদি এমন নাটক-টেলিফিল্ম বানানো অব্যাহত রাখেন, তাহলে বাকি দর্শকদের মধ্য থেকে অনেকেরও এক সময় ম্যাচিউরিটি আসবে বলে আমার বিশ্বাস।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন
 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা