ইংরেজি না জানার জন্যে হাসাহাসি করতো সবাই। স্টার্টাপ যেটাই করেছেন, সেটা নিয়েই বিপাকে পড়েছেন। এরপরে যেটা করলেন বিজয় শেখর শর্মা, সেটা শুধু তার জীবনকেই পাল্টায়নি, পাল্টিয়েছে ভারতবাসীর জীবনও!

গত বছর যখন একটা কম্পিটিশনে ভারতে গেলাম, সেখানে দেখলাম PayTM এর জয়জয়কার। বিশাল বিশাল শপিংমলগুলো তে তো আছেই, আপনি যদি রাস্তার পাশের পানিপুরিও খেতে চান, সেখানেও পেটিএম দিয়ে পেমেন্ট ক্লিয়ার করার ব্যবস্থা আছে। অবশ্য এ জিনিস তো আমাদেরও আছে। বিকাশ। বিকাশ দিয়ে যদিও রাস্তার পাশের ঝালমুড়ি খেয়ে বিল দেয়া যাবেনা, অতটা সহজলভ্য তারা হয়নি। তবে জিনিসপাতি কেনাকাটা, গ্যাস বিল, কারেন্ট বিল...সবই দেয়া যাবে। যাই হোক, ভারতে পেটিএম এসেছে ২০১০ সালের দিকে। বিকাশের বেশ আগে। আইডিয়াটাও চমৎকার। ভাবলাম, এই কনসেপ্টের মাস্টারমাইন্ড কে? সব করবো, টাকাপয়সা দেবো, অথচ মানিব্যাগে হাত দেবোনা, এটাই তো অদ্ভুত! খোঁজখবর আর ব্লগ পড়ে জানলাম, পেটিএম এর মাস্টারমাইন্ড বিজয় শেখার শর্মা। যিনি কী না ভারতের সবচেয়ে কম বয়সের বিলিয়নিয়ার। ফোর্বস ম্যাগাজিনে যাকে নিয়ে ফিচার করা হয়েছে। ইন্টারেস্টিং লাগলো। আরেকটু ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করলাম।

যেকোনো সফল ব্যক্তির শুরুর গল্পটা একটু কষ্টের, এটা আমরা সবাই জানি। বাংলা সিনেমার গৎবাঁধা স্ক্রিপ্টের যেমন কোনো চেঞ্জ নেই, তেমনি সফল ব্যক্তিদের ছোটবেলার দারিদ্রেরও কোনো পরিবর্তন নেই। গরীব স্কুল শিক্ষক বাবার ছেলে বিজয় ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনাকে নিয়েছিলেন সিরিয়াস ভাবে। স্কুলের প্রত্যেক পরীক্ষাতেই হয়েছেন প্রথম। খুব অল্পবয়সেই স্কুল থেকে পাশ করে গেলেন কলেজে পড়তে, ধাক্কা খেলেন তখনই।

দিল্লী কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং এ সবই ইংরেজিতে পড়াশোনা। এতদিন পড়েছেন হিন্দি, এখন সব ইংরেজি। আস্তে আস্তে সিজিপিএ কমতে লাগলো। তবে ভয় পাবেন না। সিনেমার শাকিব খানের মত হুট করে না হলেও আস্তে আস্তে তিনিও শিখে নিলেন ইংরেজি। কলেজে থাকতে থাকতেই ভাবলেন এমন কিছু ভাবতে হবে, যা কেউ ভাবেনি আগে৷ স্টিভ জবস তো বলেই গিয়েছেন- সফল হওয়ার একটাই মন্ত্র। নতুন কিছু আনো।

সব বাদ দিয়ে কম্পিউটারের প্রোগ্রামিং নিয়ে পড়লেন। আস্তে আস্তে শিখলেন। ছোটবেলা থেকেই মস্তিষ্ক খুব ভালো কাজ করতো। সেটারই প্রমাণ পাওয়া গেলো। প্রোগামিং শিখে খুললেন একটা সাইট indiasite.net। এই সাইট থেকে ভারতের সব ওয়েবসাইটের তথ্য পাওয়া যেতো। এটাকে বিদেশি এক কোম্পানি এক মিলিয়ন ডলার দিয়ে কিনে নিলো, সাইট শুরুর দুই বছরের মাথায়। তখনও কলেজে পড়ছেন তিনি। এর কিছুদিন পর কলেজ পাশ করলেন। কিছু বন্ধু আর সাইট বেচে পাওয়া টাকা দিয়ে খুললেন আরেকটা কোম্পানি 'One 97.' এটা অনেকটা 'ট্রু-কলার' এর মতন। কন্ট্যাক্ট নাম্বার খুঁজে বের করার জন্যে এটি ব্যবহার করা হতো। কিন্তু এই কোম্পানি মেন্টেন করতে প্রচুর টাকার প্রয়োজন। যেটা পাওয়া যাচ্ছিলো না। বিজয় পড়লেন অকুল পাথারে। কী করা যায়! রাস্তার পাশে হাবিজাবি খেয়ে, আধপেটা থেকে, টাকার ভয়ে বাড়িওয়ালার থেকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতেন আর ভাবতেন, কী পাপ করেছি! এত শাস্তি পেতে হচ্ছে কেন?

টাকাপয়সার জন্যে আর নিজের কোম্পানি চালানোর জন্যে ফ্রিল্যান্সিং শুরু করলেন। উদয়াস্ত খাটতে হতো। বিভিন্ন কোম্পানির ফ্রিল্যান্সিং করতে করতে পরিচয় হয় পোলার সফটওয়ারের মালিক পীযুষ আগারওয়ালের সাথে। পীযুষ বুঝতে পারেন, বিজয়ের মধ্যে প্রতিভা আছে। বিজয়কে অফার করেন- পীযুষের পোলার গ্রুপে 'সিইও এর চাকরি করার জন্যে। বিজয় প্রথমে রাজি হয় না। কারণ, বিখ্যাতদের বই পড়েই সে জেনেছে, সফল হতে গেলে কারো অধীনে চাকরী করা যাবেনা।

তবে এই সিদ্ধান্তের পর পরিবারের কাছ থেকে খেলেন বড়সড় এক ধমক। মানে কী? এত বড় একটা চাকরীর অফার পেয়েও কেউ ছাড়ে? এ পাগল না অন্যকিছু? পরিবারের ধাতানি খেয়ে বিজয় আবার পীযুষের কাছে যান, গিয়ে বলেন- 'আমি চাকরি করবো। কিন্তু আমাকে আমার কোম্পানি নিয়ে কাজ করার জন্যেও পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে।' কাজের পরে ততটুকু সময় বিজয়কে দেয়া হতো এবং বিজয় ঢুকলেন পোলার সফটওয়্যার এর সিইও হয়ে, ত্রিশ হাজার রুপির বেতনে।

অর্থনৈতিক ভরসা পেয়ে বিজয় আবার ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে শুরু করলেন। 'One 97' নিয়ে বেশিদূর যাওয়া যাবে না, তা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি ভাবলেন, এমন কিছু একটা করা যাক, যাতে টাকাপয়সা লেনদেনের বিষয়টা পুরোপুরি অনলাইন ও স্মার্টফোন নির্ভর হবে। আইডিয়া হলো পেটিএমের এর। যদিও প্রথমে অনেকেই এটি নিয়ে নানারকম কথাবার্তা বলেছিলেন। তাও বিজয় বাজি ধরলেন। এই ওয়েবসাইট তিনি খুলবেনই। ২০১০ সালের ৮ জুলাই, নিজের ৩৭ তম জন্মদিনে তিনি পেটিএম এর ওয়েবসাইটটি চালু করেন। বাকিটা হয়ে যায় ইতিহাস। গুগল প্লেস্টোর থেকে এ্যাপটি এখন পর্যন্ত ডাউনলোড করা হয়েছে একশো মিলিয়নেরও বেশি বার। পেটিএমের নিয়মিত গ্রাহক প্রতিদিনই বাড়ছে। পুরো ভারতই সয়লাব হয়ে গিয়েছে পেটিএমের নেটওয়ার্কে। ভারতে যে কখনো পেটিএম ছাড়াও লেনদেন হতো, এটাও ভুলে গিয়েছে মানুষজন। ওয়ারেন বাফেটের মত মানুষজনের সাথে তার এখন সখ্যতা। যাকে ডাকা হয় ভারতের দ্বিতীয় 'ধিরুভাই আম্বানি' নামেও।

সফলতার গল্প তো সবারই আছে। সেটা সমস্যা না। ইংরেজি না জানা, একের পর এক স্টার্টাপ ব্যর্থ হওয়া সেটাও সমস্যা না। কিন্তু যদি কখনো মাথা থেকে একটা অন্যরকম আইডিয়া আসে এবং সেই আইডিয়াকে নিয়ে পাগলের মতন খাটা যায়, তাহলেই দিনশেষে অসাধারণ কিছু গল্প তৈরী হয়। এটাই মূল কথা। বিজয় শেখর শর্মা কিছুই করেননি আহামরি। তিনি সেটাই করেছেন, যেটা সফলেরা করেন। নিজে একটা আইডিয়া এনেছেন মাথায়, সেই আইডিয়াকেই জীবন বানিয়েছেন। সফল হওয়ার সূত্রও এই একটিই। ধাক্কা খেতে হবে। উঠে দাঁড়াতে হবে। এই আইডিয়া নিয়েই এগোতে হবে। এটাই সাকসেসের একমাত্র টনিক।

এবং মাথায় রাখতে হবে আরেকটি কথা, যেটি ওয়াংখেড়েতে বিদায়ী ম্যাচের পরে শচীন টেন্ডুলকার বলেছিলেন- "দেয়ার ইজ নো শর্টকাট ইন সাকসেস!"

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা