ক্ষমতাসীন বিজেপির এক প্রভাবশালী নেতাকে থানায় ২৫ জন পুলিশের সামনে গুলি করে মেরেছিলেন বিকাশ, অথচ ভয়ে কেউ সাক্ষ্য দিতে আসেনি তার বিরুদ্ধে! উত্তরপ্রদেশের আতঙ্কে পরিণত হওয়া সেই গ্যাংস্টারের পতনটাও হলো ফিল্মি স্টাইলে...

উত্তরপ্রদেশের রাজধানী লাখনৌ থেকে মাত্র দেড়শো কিলোমিটার দূরে কানপুরের জেলাধীন বিকরু গ্রাম। তিনটি পুলিশ স্টেশনের সম্মিলিত পঞ্চাশ জনের বাহিনীর দল গেছে সেই গ্রামে এক গ্যাংস্টারকে গ্রেফতার করতে। যথারীতি স্থানে পৌঁছালেই, পুলিশের দলটির ওপর তিন দিক থেকেই হামলা শুরু হয়৷ এতে মোট আটজন পুলিশ নিহত হয়, অপরপক্ষে দুজন! ২০০১ সালের ঘটনারই যেন পুনরাবৃত্তি দেখলো উত্তরপ্রদেশ। নৃশংসতার শিরোনামে ফের হাজির বিকাশ দুবে, যার নামে উত্তরপ্রদেশ কাঁপতো এক সময়! 

সেই ঘটনার সাত দিন পার হয়ে গেল, উত্তর প্রদেশের পুলিশ হন্য হয়ে খুঁজছে বিকাশ দুবেকে। অবশেষে মহাকাল মন্দিরে খোঁজ মিললো তার, গ্রেফতার হলে স্পেশাল টাস্ক ফোর্সের তৎপরতায়। পরদিনই কোর্টে হাজির কথা থাকলেও, সকালে উজ্জয়িনী থেকে কানপুর আসার পথিমধ্যেই বিকাশের বহনকারী গাড়িটি রাস্তায় উল্টে যায়৷ এমতাবস্থায় পুলিশের কোমর থেকে বন্দুক ছিনিয়ে গুলি করে পালানোর চেষ্টা করলে, বুকে ও কোমরে পাল্টা গুলি খেয়ে মৃত্যুমুখে ধাবিত হয় বিকাশ দুবে। উত্তরপ্রদেশের পুলিশ সূত্রে এমনটা দাবী আসলেও বুঝতে বাকি থাকে না আদতে কি হয়েছে। স্থানীয় হাসপাতালে মৃত ঘোষণার পর, দীর্ঘ ত্রিশ বছরের একটি ভয়ানক অধ্যায়েরই যেন পরিসমাপ্তি ঘটলো। আইনের প্রয়োগের ধরণটা প্রশ্নবিদ্ধ হলেও, বিকাশের মৃত্যুতে স্বস্তির নিঃশ্বাসই যেন ফেললো কানপুরের জনসাধারণ।

বিকাশ দুবে'র জন্ম উত্তরপ্রদেশের কানপুর জেলার বিকরু গ্রামে। যৌবনের রঙে পা দিতেই, তৈরি করে ফেলেছিলো নিজস্ব দল, হ্যাঁ সন্ত্রাসী দলের কথায় বলছি। যদিও সিনেমার গ্যাংস্টারদের বেশভুষার আদলেই মূলত তাকে বিশেষণ দিতো সকলে। জীবনের প্রথম হত্যা মামলা হয়েছিলো নব্বই সালে, নিজ গ্রামেরই দুই দলিত সম্প্রদায়ের লোককে মেরে ফেলার ঘটনায়৷ এরপর থেকেই অসংখ্য মামলা তাকে অচিরেই প্রভাবশালী ও ভয়ঙ্কর করে তোলে নিজ অঞ্চলে। হয়ে উঠেন কানপুরের সবচাইতে 'মোস্ট ওয়ান্টেড' ব্যক্তি৷ 

গ্যাংস্টার বিকাশ দুবে

১৯৯৯ সালে নিজ গ্রামের জুন্না বাবাকে হত্যা করে জোরপূর্বক জমি হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠে তার বিরুদ্ধে। এক বছর পরেই, নিজ শিক্ষক, অবসরপ্রাপ্ত কলেজ অধ্যক্ষ সিদ্ধেশ্বর পান্ডে হত্যা মামলার আসামী হয়ে কিছুদিন জেলও খাটেন। এটি ছিল একমাত্র মামলা, যাতে বিকাশ যাবজ্জীবন কারাদন্ডের শাস্তি পেয়েছিলেন। কিন্তু কোনোভাবে হাইকোর্টের মামলায় জামিন পেয়ে যান। সুতরাং বিকাশ দুবেকে কাবু করার কোনো সুযোগই আসছিলো না।

তবে যে ঘটনাটি বিকাশ দুবেকে ভারতবর্ষ রাতারাতি মিডিয়া কভারেজ পাইয়ে দিয়েছিলো, সেটি হলো ২০০১ সালে যথারীতি একটি খুনের ঘটনা। উত্তরপ্রদেশে তখন বিজেপির শাসন চলছে৷ তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে ছিলেন ভারতের বর্তমান প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং৷ এমতাবস্থায় এক ভয়ংকর ঘটনায় কেঁপে উঠলো পুরো উত্তরপ্রদেশ, নাড়া দিয়ে গেল রাজ্যের সার্বিক আইন শৃঙখলাকেও। কানপুরের শিবলি থানার মধ্যে সন্তোষ শুক্লা নামের এক বিজেপি নেতা যিনি কিনা প্রতিমন্ত্রীর সমান মর্যাদাপ্রাপ্ত সরকারি পদেও ছিলেন, তাকে ধাওয়া করে থানার ভেতর নিয়ে গিয়ে গোটা ত্রিশেক পুলিশকর্মীর সামনেই বুলেটে ঝাঁঝরা করে দিলেন বিকাশ দুবে! 

চার মাস পর যখন আত্মসমর্পণ করলেন, তখন তাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠলো বহুমাত্রিক রাজনৈতিক হিসাব নিকাশ। পাশে এসে দাঁড়ালো অনেক প্রখ্যাত ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা। খুনের সময় থানায় দাঁড়িয়ে থাকা ২৫ জন পুলিশকর্মীর একজনও সাক্ষী দিতে যাননি, অচিরেই প্রমাণের অভাবে বেকুসুর খালাস দিতে বাধ্য হয় আদালত।

বিকাশ দুবে পারিবারিকভাবে ব্রাহ্মণ ছিলেন। কিন্তু একজন ব্রাহ্মণ, আবার কিনা গ্যাংস্টার! জাতপাতের লড়াইটা উত্তরের ভারতের সংস্কৃতির সংকীর্ণ প্রচলিত ধারা, যা এখনো ব্যাপকভাবে বিদ্যমান। নিন্মবর্ণের হিন্দুরা বরাবরই সামাজিকভাবে অবহেলিত হলেও, রাজনীতির ময়দানে তাদের ভিতরে একরকম ঐক্য কাজ করে। যা আবার উচ্চবর্ণের হিন্দুদের মধ্যে খুব একটা উপস্থিত নেই, বরং তারা বিক্ষিপ্ত ও দুর্বল৷ এর ফলে উচ্চবর্ণের হিন্দু নেতারা রাজনীতিতে কোণঠাসা হিসেবেই গণ্য হয়। 

এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে গ্যাংস্টাররাই যখন শেষভরসা তখন ব্রাহ্মণ গ্যাংস্টার বিকাশ দুবেকে পেয়ে যেন, তারা আস্থার প্রতীক খুঁজে পেল৷ তাই বলা যায়, এই পরিচয়ই মূলত বিকাশ দুবেকে আলাদাভাবে তুলে এনেছে সকলের সামনে। এমন কি দলিত সম্প্রদায়কে চাপে রাখতে অনেক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুও হয়ে উঠেন এই লোক। সুতরাং বলা বাহুল্য, রাজনীতিতে ধর্মীয় কুসংস্কার ও সাম্প্রদায়িক ছাপকে উজ্জীবিত রাখার প্রচেষ্টাতেই একজন বিকাশ দুবের সামগ্রিক উত্থানের কারণ, যা তাকে প্রতিনিয়ত বেপরোয়া করে তুলেছিলো। এর একটি উদাহরণ পাওয়া যায় এভাবে, মাত্র বিশ হাজার টাকার বাকবিতণ্ডাকে কেন্দ্র করেই দিনেশ নামক এক ক্যাবল অপারেটরের হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত হয়ে পড়েছিলো বিকাশ।

পুলিশের হাতে গ্রেফতারের পর বিকাশ দুবে

সময়ের পরিক্রমায় রাজনীতিতেও বিকাশ দুবে হয়ে উঠলেন ক্ষমতায় যাওয়া ও ধরে রাখার অদৃশ্য সিঁড়ি। হয়ে উঠলেন চরম রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নে তৈরি সামাজিক কীট। সমাজবাদী, বহুজন সমাজবাদী কিংবা বিজেপি, প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের আশীর্বাদপুষ্ট ছিলেন তিনি৷ বিকাশ নিজ গ্রামের পঞ্চায়েতে টানা ১৫ বছর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ছিলেন জেলা পরিষদের সদস্য। এখানে থেমে না থেকে, নিজের স্ত্রীকেও জেলা পরিষদের সদস্য বানিয়েছিলেন। 

উত্তরপ্রদেশে যে রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় এসেছেন, বিকাশের হিংস্রাত্মক কাজকে আশ্রয় ও প্রশ্রয় দিয়ে সেই দলের নেতারা নিজেদের স্বার্থ হাসিলে ব্যতিব্যস্ত হয়েছেন। বিকাশ নিজেও দলের লেবাস পাল্টেছেন বারবার। কখনো সমাজবাদী পার্টির পোস্টারে কখনোবা রাজনৈতিক গুরুর বিজেপি ত্যাগের পথ ধরে বহুজন সমাজবাদী পার্টিতে যোগদান, সবটারই দেখা পাওয়া গেছে। যতবার গ্রামের প্রধান হয়েছেন, ভোটের আগে প্রচারে যাওয়া লাগেনি। তার নামটাই যথেষ্ট ছিল, ভোট বাক্স ভরে উঠার জন্য। একবার তো জেলে বসেই নির্বাচনে জিতেছিলেন।

যোগী আদিত্যনাথ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পরে, বিকাশ চেয়েছিলেন বিজেপিতে সরাসরি নাম লেখাতে। ঠাকুর নেতার আমলে কোণঠাসা ব্রাহ্মণরা, এমন আবহ তৈরি হলে ব্রাহ্মণ নেতারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন বিকাশকে নিজেদের স্বার্থে দলে ভেড়াতে। কিন্তু বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ও আদিত্যনাথ সেই আবদার আমলে নেননি। বিজেপি সরকার আসার পর থেকেই বিকাশের মাথার দাম ঘোষণা করা হয়েছিলো পঁচিশ হাজার রূপি। এবং শেষ পরিণতিও আদিত্যনাথ দেখে ছাড়লেন। 

যদিও অনেকের মতে, বিকাশের অত্যাধিক বেপরোয়া মানসিকতা ও অপরিণামদর্শী চিন্তার পরিণতি হয়েছে এমন। তার ইচ্ছা ছিল আগামী বিধানসভা নির্বাচনে এমএলএ হওয়ার, সেভাবেই প্রস্তুতিও নিচ্ছিলেন বিকাশ। বিএসপি অথবা বিজেপিকেই নিজের গন্তব্য ভাবছিলেন। কিন্তু তা আর হলো কোথায়, একজন গ্যাংস্টার বিকাশ দুবের দেহ লুটিয়ে রইলো উজ্জয়িনী থেকে কানপুরের রাস্তায়, নিজের কুখ্যাতি ও কৃতকর্মের কীর্তিতে... 

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা