নব্বুই দশকের ছেলেমেয়েদের কাছে ভার্জিন কোলা এক পরিচিত বস্তু। শৈশবের চেনা এই ড্রিংকসটি একসময়ে বাজার থেকে ধীরে ধীরে হারিয়ে গেল। কিন্তু কেন? তার পেছনের ঘটনাটা জানেন কি.....
ছোটকালে আমার সবচেয়ে প্রিয় ড্রিংকস ছিল ভার্জিন কোলা। কেন প্রিয় ছিল তা ঠিক জানি না। ছোটবেলার অনেক অভ্যাস, আচরণেরই আজকাল কোনো লজিক খুঁজে পাই না। তেমনি এতো কিছু থাকতে ভার্জিন কোলা কেন আমার প্রিয় হয়েছিল তার শক্ত কোনো যুক্তি এই মুহুর্তে দেখাতে পারব না। তবে সম্ভবত ভার্জিন কোলার বোতলের শেপটার জন্যে এটাকে অন্য সবার চেয়ে আলাদা লাগত। সেকারণেই বোধহয়, এই পানীয়টা সবচেয়ে বেশি পান করা হয়েছে শৈশবে।
প্রায় দিনই আমি স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে মুদি দোকান থেকে একটা করে আড়াইশো মিলির ছোট্ট বোতলের ভার্জিন কোলা নিয়ে যেতাম বাসায়। তখন মুদি দোকান থেকে বাকি খাওয়ার অভ্যাস ছিল আমাদের। আব্বার নামে দোকানে একটা হিসাব খাতা ছিল। আমার কাছে যেহেতু টাকা থাকত না, আমি দোকান থেকে ভার্জিন কিনে বলতাম, খাতায় লিখে রাখেন। আচ্ছা তখন দাম ছিল কত? ১২ টাকা কি? ঠিকঠাক মনে নেই, তবে ভার্জিন কোলার কথা মনে আছে ভীষণ...
ভার্জিন কোলার ইংরেজিটা ছিল এমন 'Virgin Cola'। বড় বেলায় এসে আমি এই শব্দটা নিয়ে অনেক 'পান' শুনেছি, অনেকরকমের মজার মজার আলাপ শুনেছি। ভার্জিন শব্দের অর্থ জেনেছি অনেক পরে এসে। ভার্জিন নারী ব্যাপারটা নিয়ে অনেক গবেষণা, আলাপ আলোচনা শুনেছি একটু বাড়ন্ত বয়সের ছেলেপেলেদের মধ্যে। ভার্জিন বলতে কুমারী নারীর যে প্রতিচ্ছবি তৈরি হয়, সেদিক থেকে ভাবলে একটু কৌতুহল হতেই পারে কেন একটা কোমল পানীয়জলের নাম রাখা হলো ভার্জিন?
একটু ডিকশনারিতে ঘুরে এসে জানলাম, Virgin শব্দের অর্থ 'বিশুদ্ধ' ও হয়। তাহলে এই পানীয় বিশুদ্ধ এইরকম বোঝাতে এই নাম? উত্তরটা সবচেয়ে ভাল জানবেন হয়ত উদ্যোক্তা।
আপনি যদি আগে না জেনে থাকেন, তাহলে বলি ভার্জিন গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা আপনার কাছে হয়ত অচেনা নন। ভদ্রলোকের নাম রিচার্ড ব্র্যানসন। বিখ্যাত বিলিয়নিয়ার রিচার্ড ব্র্যানসনকে বলা হয় ব্রিটিশ ব্যবসার মোঘল। এই এক মানুষের মালিকানায় চলে শত কোম্পানি। অনেক কোম্পানি, অনেক উদ্যোগের ভীড়ে রিচার্ড ব্র্যানসনের একটি উদ্যোগের নাম 'ভার্জিন কোলা'।
স্কুলে গন্ডি পেরোতে পারেন নি, প্রেমে ব্যর্থ হয়ে লিখেছিলেন সুইসাইড নোট, সেই মানুষটার ব্যবসায়ে সাফল্য এতোটা ঈর্ষণীয় যে, দুনিয়াজুড়ে শত সহস্র উদ্যোক্তার আইকন তিনি। অথচ, তুমুল সফল এই মানুষটার যে কয়েকটা ব্যর্থতা খুব বেশি আলোচিত তার মধ্যে একটি হলো 'ভার্জিন কোলা'।
১৬ বছরে স্কুল ম্যাগাজিন করে, বিজ্ঞাপনের প্রচার করে বেশ আলোচিত তিনি। ২০ বছর বয়সে শুরু করলেন মতো মিউজিক রেকর্ড মেইলের মাধ্যমে বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেয়ার ব্যবসা। ব্যবসার নাম দিলেন 'ভার্জিন মেইল'। সেই থেকে তিনি আরো অসংখ্য উদ্যোগ নিয়েছেন যাদের নামকরণের শুরুতে ছিল 'ভার্জিন' শব্দটি। এমনকি 'ভার্জিন ভোদকা'ও আছে তার মালিকানাধীন।
তাহলে, বুঝতেই পারছেন 'ভার্জিন কোলা' শুরু হওয়ার আগেই রিচার্ড ব্র্যানসনের 'ভার্জিন' কোম্পানির যাত্রা শুরু। কিন্তু কেন এই শব্দটা দিয়ে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করলেন তিনি?
ঘাটাঘাটি করতে করতে জানতে পারলাম এক ঘটনা। মিউজিক রেকর্ড মেইলে পৌঁছে দেবার ব্যবসা শুরুর দিকেই অনেকগুলো নাম ভাবছিলেন রিচার্ড ব্র্যানসন। কিন্তু কোনো নামই পছন্দ হচ্ছিলো, মনের মতো হচ্ছিলো না। এমনই সময়ে রিচার্ডের এক বন্ধু এসে বললেন, "দেখো আমরা তো ব্যবসার দুনিয়ায় আগে কখনো ঢুকি নাই, মানে হইলো এই ব্যবসা না করার দিক দিয়া আমরা এই জগতে ভার্জিন (Virgin)। সম্ভবত তখনই 'ভার্জিন' শব্দটাকে রিচার্ড ব্র্যানসনকে আকৃষ্ট করে আর সেই থেকে রিচার্ড ব্র্যানসনের উদ্যোগগুলোর নামকরণ হতে থাকে 'ভার্জিন' শব্দের ব্যবহারে। যদিও, এখন ব্যবসায় এতো বেশি ঈর্ষণীয় সাফল্য 'ভার্জিন' কোম্পানির যে, অভিজ্ঞতার হিসেবে তারা অন্তত আর ভার্জিন নেই!
যাইহোক এই ভার্জিন কোলা বাজারে আসে নব্বুই দশকে, ১৯৯৪ হবে সময়টা। নব্বুই দশকেই বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠে ভার্জিন, বিশেষ করে যুক্তরাজ্যে, লন্ডনে নব্বুইয়ের শেষের দিকে ভার্জিন কোলার জনপ্রিয়তা খুব তুঙ্গে। রিচার্ড ব্র্যানসন তার 'ভার্জিন' ব্র্যান্ড বা নামটাকে ছড়াতে চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন কোকাকোলা, পেপসির সাথে বাজারদখলের যুদ্ধে নামতে। ভার্জিন কোলা সেই পথেই এগুচ্ছিলো। বাজারে আসতেই মার্কেট শেয়ারের উল্লেখযোগ্য অংশ ভার্জিন কোলা আকর্ষিত করতে সক্ষমও হয়।
আমাদের দেশে ঠিক কখন থেকে ভার্জিন কোলা আসতে শুরু করে তা জানি না এই মুহুর্তে, তবে সম্ভবত নব্বুই দশকের শেষের দিক থেকে দেশে আসে ভার্জিন কোলা। তবে, খুব বেশি সময় ভার্জিন কোলা ছিল না বাজারে। আমরাও বড় হয়েছি, ধীরে ধীরে কিভাবে যেন ভার্জিন কোলাও হারিয়ে গেছে কখন আলাদা করে টের পাইনি। একদিন হুট করে মনে হয়েছে আরেহ, ভার্জিন কোলা নামে একটা ড্রিংকস খেতাম যে, ওটা তো আর নাই।
হুট করেই হারিয়ে গেলেও, হারিয়ে যাওয়াটা ভার্জিন কোলার জন্যে অবশ্যম্ভাবীই ছিল। রিচার্ড ব্র্যানসন চেয়েছিলেন কোকাকোলাকে হার মানাতে। কোক বিশ্বের সেরা ব্র্যান্ডদের একটি, তাদের হার মানাতে পারলে রিচার্ড ব্র্যানসন খুব মজা পেতেন, এটা এক অবিশ্বাস্য ব্যাপারও হতো। কিন্তু কোকাকোলার বাজার দখল রাখবার কৌশলের কাছে মার খেয়েছেন তিনি।
কোকাকোলা খুচরা বিক্রেতা ও ডিলারদের কাছে এমন কিছু বিশেষ অফার ছাড়তে থাকলো যে, লোভনীয় সেই অফার তাদের পক্ষে প্রত্যাখ্যান করার সুযোগ ছিল না। ফলে, যে ভার্জিন কোলা তুমুলভাবে চলছিল বাজারে, সেই বাজারেই তাকে তাকে খালি হয়ে গেল, ভার্জিন কোলার বোতল আর সেখানে থাকলো না। সেই জায়গায় আসলো কোকাকোলা। সগৌরবে বাজারের রাজা বনে গেল যেন।
ব্র্যানসন নিজেই তাই স্বীকার করেন, তার এই জীবনে যত যা উদ্যোগ নিয়েছেন সবচেয়ে ব্যর্থ উদ্যোগ ছিল 'ভার্জিন কোলা'।
২০০৫ এর পর থেকে ভার্জিন কোলাও তাই ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকে। যুক্তরাজ্যের খুব লিমিটেড কিছু জায়গায় বা তার বাইরের স্বল্পসংখ্যক ভার্জিন কোলা চললেও গোটা দুনিয়া থেকে হারিয়ে যায় এই কোলা। তবে, আমরা যারা শৈশবে ভার্জিন কোলা পান করেছি, তাদের স্মৃতিতে হয়ত বিশেষ জায়গাজুড়েই থাকবে 'ভার্জিন কোলা'। ভার্জিন কোলা পান করা নব্বুই দশকের ছেলেপেলেরা হয়ত কেউই 'ভার্জিন' থাকবে না কিন্তু ভার্জিন সত্যিই থাকবে স্মৃতির মার্জিনে...