এই যে করোনাকালে দেশের সব শপিং মল বন্ধ, নিউ মার্কেট হয়ে আছে সাহারা মরুভূমি, সিনেমা হলে সিনেমা চলছে না, রাস্তাঘাটে লোকজন নেই, বাংলাদেশ নেপাল ফুটবল ম্যাচে গ্যালারি বন্ধ করে একটা মাছি পর্যন্ত ঢুকতে দেয়া হয় নাই, সব ওয়াজ-মাহফিল, সভা-সমাবেশ, জন-জমায়েত বন্ধ- এমন এক দেশে বইমেলা তো অবশ্যই বন্ধ রাখা উচিৎ...
লেখালেখি করার সূত্রে লেখক, প্রকাশক, পাঠক এই তিন পক্ষের সাথেই একটা নিবিড় সম্পর্ক বা জানাশোনা আমার রয়েছে। সেই জানাশোনার সূত্র ধরেই একটা বিষয় খুব বুঝতে পারি, তাহলো বাংলাদেশে এই প্রকাশনা শিল্প আসলে কী অবস্থায় রয়েছে?
বা একটি শিল্প (ইন্ডাস্ট্রি) হয়ে উঠতে হলে তাদের কী দরকার?
সবার আগে যেটি দরকার সেটি হলো সক্ষমতা। এই সক্ষমতা আসলে কীসের?
অনেকেই হয়তো নাক সিটকে বলবেন, 'বাজারি' লেখক সাদাত হোসাইনতো বই বিক্রির কথাই বলবেন। জি, আপনার ধারণা সঠিক হয়েছে, আপনি জয়যুক্ত হয়েছেন। সত্যি কথা বলতে, হ্যাঁ, আমি বই বিক্রির কথাই বলবো। কিন্তু কেন ?
সেই প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি। বই নিয়ে, বইয়ের প্রকাশনা কিংবা নিদেনপক্ষে আমার একটা বই-এর দোকান থাকবে, এমন স্বপ্ন দেখেন, এমন লোকের সংখ্যা কিন্তু কম নয়। কিন্তু একটা অতি সাধারণ দৃশ্য প্রায় সবসময়ই আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়। দৃশ্যটি হলো, বই নিয়ে শুরু হওয়া এমন অসংখ্য উদ্যোগ বা স্বপ্ন শেষ পর্যন্ত আর আলোর মুখ দেখে না। কিংবা মাঝপথে বা শুরু হতেই মুখ থুবড়ে পড়ে।
এই দৃশ্যগুলো আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়, কারণ ঘটনাগুলো এতো হরদম ঘটে, এতো বেশি স্বাভাবিক যে এটাকে আলাদা করে দৃষ্টি দেবার প্রয়োজন বলে আর মনে হয় না। মনে হয়, ‘আরে ধুর, এইটাইতো হওয়ার কথা ছিল!’
আর স্বাভাবিক বলেই প্রতি বছর অসংখ্য নতুন ছোট ছোট প্রকাশনা সংস্থার জন্ম যেমন আমাদের আলোড়িত করে না, আলাদা করে চোখে পড়ে না, তেমনি বছর ঘুরে বছর আসার আগেই এদের মৃত্যুও না। বন্ধ হয়ে যাওয়াটাও না।
প্রতি বছর অসংখ্য বইয়ের দোকান বা আড়ম্বর করে উদ্বোধন করা শো রুম আমাদের চোখে পড়ে। সেগুলো দেখে আমরা কতোটা আমোদিত হই আমি নিশ্চিত নই, তবে এটি নিশ্চিত যে মনের ঈশান কোণে শঙ্কার কালো মেঘ ঠিকই উঁকি দেয়, ‘কয়দিনের জন্য? এই দোকান চলবে কয়দিন? ভাড়াইতো উঠবে না…’।
কথা সত্য। ভাড়াও আসলে ওঠে না। দোকান বন্ধ হয়ে যায়। নান্দনিক অলংকরণ আর স্বপ্নের সমাধি ঘটে পরের মাসের ফার্স্টফুডের দোকানের ডেকোরেশনে। কাপড়ের দোকানের আয়োজনে। ‘গ্রন্থকানন বা আলোর মিছিল’ নামক বইয়ের লাইব্রেরীর সমাধির ওপর সগৌরবে গড়ে ওঠে ‘স্পাইসি চিকেন, রেডি কিচেন, ঝটপট হট শট পিৎজা’র দোকানে। পাকিস্তানি লন আর ভারতীয় লেহেঙ্গার ফ্যাশন হাউজে।
এসব আমাদের চোখ সয়ে গেছে। ফলে বইয়ের দোকান নিয়ে বুকের ভেতর ক্ষয়ে যেতে আমাদের বয়েই গেছে!
মাঝেসাঝে হয়তো দুবার জিভ চুকচুক করে আফসোস প্রকাশ করি। তারপর সেই জিভে ওই স্পাইসি চিকেন আর হট পিৎজা চেখে আহ উহ করতে করতে ফেসবুকে চেক ইন দেই। ততক্ষণে আরও আরও বইয়ের দোকান , স্বপ্নালু চোখ জগতের সব শোক বুকে চেপে ধুকে ধুকে মৃত্যুপথের যাত্রী হয়।
হ্যাঁ, হয়।
আমরা যখন ‘এর বই কিনবেন কেন? তার বই কিনবেন কেন? তারতো কিছু হয় না, সে কোন লেখকই না’, এমন মুহুর্মুহু ঝগড়ায় ফেসবুক প্রকম্পিত করি, তখন ছাপাখানা বন্ধ হয়ে যায়, কারণ বইয়ের পাঠক নেই, বাঁধাই খানার শ্রমিক বেকার হয়, কারণ ছাপার জন্য যে অল্প পরিমাণ বই আসে, তাতে তাদের জীবিকা নির্বাহ হয় না। প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। কিংবা ওই ধুকে ধুকে বেঁচে থাকে। অপেক্ষায় থাকে, আবার জমবে মেলা…
মেলা কি আসলেই জমবে?
জমবে কী না জানি না। শুনছি, বইমেলা হবে না। তার আগে আরও অনেক কিছু শুনেছি বছর জুড়েই। এই করোনা শুরু হওয়ার পর থেকেই… দেশে কতগুলো বই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান চোখের পলকে ‘নাই’ হয়ে গেছে, সে খবর আমরা রাখিনি।
এই ঢাকা শহরেই কতগুলো বইয়ের স্বপ্ন দেখা নান্দনিক প্রচেষ্টা তাদের ব্যবসা গুঁটিয়ে বাড়ির পথ ধরেছে, সে খবরও রাখিনি? কতগুলো বন্ধ হওয়ার অপেক্ষায় ধুঁকেধুঁকে টিকে আছে, সে খবরও না।
আমরা জানি না, বই সংশ্লিষ্ট অন্যান্য যে স্টেক হোল্ডাররা (প্রকাশক, লেখক, ছাপাখানা কর্মী, মালিক, বাঁধাই ঘর, কর্মী ইত্যাদি) রয়েছেন, তাদের কার কী অবস্থা?
এই খাতে প্রণোদনা আছে কী না আমার জানা নেই। হয়তো লাগেই না। নিশ্চয়ই বইয়ের প্রকাশনার সাথে যারা যুক্ত হন, তারা সকলেই স্বাবলম্বী, স্বাবলম্বী না হলে কি আর কেউ নান্দনিক চর্চার সাথে যুক্ত হয়?
কে জানে, এটাই হয়তো ভাবনা। আর এই ভাবনার কারণেই হয়তো, লেখক যখন বই বিক্রির জন্য প্রচারণা করেন, তখন আমাদের গাত্রদাহ হয়। প্রকাশক যখন তাঁর লেখককে নিয়ে সরব হন, তখন আমাদের যন্ত্রণা তৈরি হয়।
কিন্তু আমরা কখনোই ভাবি না যে এই বইয়ের ভাবনা, লেখা থেকে শুরু করে উৎপাদন, এই পুরো প্রচেষ্টার সাথেই অসংখ্য মানুষের শ্রম,মেধা, সময় যুক্ত।
এই প্রত্যেকটা মানুষের জীবন - জীবিকা এই বই বিক্রির ওপরই নির্ভরশীল। আমরা যে ঝাঁ চকচকে বইয়ের দোকান-স্টল দেখি, সেটা সাজাতে পয়সা লাগে, ওই জায়গাটুকুর ভাড়া লাগে, ওই স্টলে কাজ করা ছেলে মেয়েগুলোকে বেতন দিতে হয়…
আমরা যে শো রুম গুলো দেখি, সেখানেও এই একই হিসেব। আর এইসব হিসেব মেলানোর একমাত্র উপায় ওই বই বিক্রি।
বই কি বিলাস দ্রব্য? নাকি মৌলিক চাহিদা? এটা মানুষ কেন কিনবে? কখন কিনবে?
এই প্রশ্নের উত্তর আমি সম্ভবত জানি না। বা জানতে চাই না। তবে আমাদের বাস্তবতায়, এই প্রশ্নটি সত্যিকার অর্থেই সহজ।
আরও সহজ যখন করোনার মতো কঠিন পরিস্থিতি তৈরি হয়। কারণ বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার তুলনায় বই কেনা লোকের সংখ্যা কেন এমন বিস্ময়কর রকম কম, তা রীতিমতো রহস্যের বিষয়। বইমেলা ছাড়া সারা বছর প্রকাশকসহ বই সংশ্লিষ্ট অন্যান্যরা আসলে কীভাবে বেঁচে থাকেন সেটিও একটা রহস্যের বিষয়।
সত্যিকারার্থেই রহস্য।
এই রহস্য উদ্ঘাটিত হয়নি। বরং প্রকাশকরা এক বইমেলার বই বিক্রির অর্থ দিয়ে সারা বছর অপেক্ষায় থাকেন, দাঁতে দাঁত চেপে ক্যালেন্ডারের পাতা গুনতে থাকেন, আবার কবে বইমেলা আসবে? ওই ফেব্রুয়ারির এক মাস। তারপর আবার একবছর অপেক্ষা।
যন্ত্রণাময় অপেক্ষা।
সেই একবছর এবার সম্ভবত কয়েকবছরের যন্ত্রণা দিয়েছে তাদের। কারণ করোনা! সার্বিকভাবে একটি নাজুক অর্থনৈতিক সামর্থ্য, ক্রয়ক্ষমতা এবং শংকা তৈরি হয়েছে মানুষের। এই সময়ে মানুষ যতটা সম্ভব হিসেব করেই তাঁর মৌলিক চাহিদা পূরণ করার চেষ্টা করেছে। চাল, আটা, নুন, তেলের হিসেব কষে কিনতে চেয়েছে।
হাজার হাজার মানুষ থাকার ভাড়া না দিতে পেরে শহর ছেড়েছে। চাকরি হারিয়েছে। সেখানে বই? বই কে কিনবে? বই কি মৌলিক চাহিদা? এ না কিনলে, না পড়লে বাঁচা যায় না?
আচ্ছা, বই এদেশের মানুষের কত নম্বর চাহিদার তালিকায় থাকবে? একশ? পাঁচশ? হাজার?
কতজনের?
এগুলো হাস্যকর প্রশ্ন মনে হয়? হতে পারে। কিন্তু এটাই বাস্তবতা। আরও বাস্তবতা এই করোনায় সেই বই বিক্রি ‘বেশিরভাগ’ প্রকাশকদেরই আশঙ্কাজনক রকম কম। অথচ তাদেরও খেয়ে পড়ে বাঁচতে হয়। দোকান ভাড়া দিতে হয়। ওই যে দোকানের তাকে একটা বই সাজিয়ে রাখতে দেখেন, ওই বইটা রাখতে যে এক ইঞ্চি জায়গা লাগে, ওই জায়গাটুকুর ভাড়ারও হিসেব কষতে হয়। একটা বই কতদিন অবিক্রিত থেকে কতটুকু জায়গা দখল করে রাখলো, এই হিসেবটা মাথায়, মনে ও খিদা জরজর পেটে রাখতে হয়। রাখতে হয়, ওই দোকানের বাইরে অবিক্রিত বহু বই স্তুপ করে রাখার জন্য যে গুদামঘর খানা ভাড়া করা হয়েছে, সেখানার হিসেবও।
তারপরও তারা অপেক্ষায় থাকেন বইমেলার। কৃষক যেমন মৌসুম শেষে ফসল ওঠার অপেক্ষায় থাকেন, তারপর গঞ্জে গিয়ে সেই সোনালী ফসল বিক্রি করে আলোঝলমলে মুখে ঘরে ফেরেন, যদিও তিনি জানেন এই ফসলে ফি বছর অবধি যেতে ভারি কষ্ট হয়ে যাবে, তারপরও ওই মৌসুম শেষে ফসল ওঠার অপেক্ষায়ই সে থাকে। বইয়ের সাথে সংশ্লিষ্টরাও।
তাহলে? এই যে বইমেলা স্থগিত হয়ে গেলো? বা প্রস্তাবনা এসেছে? এটা কি ঠিক নয়?
নিশ্চয়ই ঠিক। করোনার মতো এই যে মহামারি, যাতে দেশের সব শপিং মল বন্ধ, নিউ মার্কেট আফ্রিকার সাহারা মরুভূমি, সেখানকার সব দোকান-পাট বন্ধ, সিনেমা হলে সিনেমা চলছে না, রাস্তাঘাটে কোনো লোকজন নেই, বাংলাদেশ নেপাল ফুটবল ম্যাচে গ্যালারি বন্ধ করে একটা মাছি পর্যন্ত ঢুকতে দেয়া হয় নাই, সব ওয়াজ-মাহফিল, সভা-সমাবেশ, জন-জমায়েত বন্ধ, এমন এক দেশে বইমেলাতো অবশ্যই বন্ধ রাখা উচিৎ…
উচিৎ না? না-কি?
না-কি আর সব স্বাভাবিক ভাবে চলতে দিয়ে, খুলে দিয়ে কেবল বইমেলাটাই বন্ধ রাখা উচিৎ? কারণ এই এক বইমেলার কারণেই করোনা ছড়িয়ে পড়তে পারে দিকবিদিক?
তাছাড়া এর সাথে সংশ্লিষ্ট সবাইতো হাওয়া খেয়ে বাঁচতে পারে… কিংবা বইয়ের ভেতর ছাপা হওয়া জ্ঞান গলধঃকরণ করেও? পারে না? হয়তো।
নাহলে? নাহলে বইমেলাটাও তো হতে পারতো! পারতো না? করোনার নিরাপত্তার বিষয়টাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধীকার দিয়েই হতে পারতো…? পারতো মাসখানেক পিছিয়ে দিয়েও শীত খানিক কমে এলে করোনা পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটবে, বিশেষজ্ঞদের এই পূর্বাভাস মাথায় রেখেও? সাথে সামাজিক দূরত্বটাকে যতটা সম্ভব অগ্রাধীকার দিয়েই?
কী জানি! আজকাল কতকিছুইতো বুঝি না। না হয়, এটাও না বুঝলাম।