বিতর্কিত সেই সংবাদ সম্মেলনের পরে বিবেক ওবেরয়কেই ভিলেন বানিয়েছে সবাই, সালমানের কিচ্ছু হয়নি, উল্টো বিবেক সব হারিয়েছেন, ক্যারিয়ার, মানুষের ভালোবাসা, এমনকি প্রেমিকা ঐশ্বরিয়াকেও!

হুট করে নেয়া একটা 'ভুল' সিদ্ধান্ত যে জীবনের গতিপথ কতখানি বদলে দিতে পারে, সেটা বিবেক ওবেরয়ের চাইতে ভালো হয়তো কেউ বুঝিয়ে বলতে পারবেন না। পেছনে ফিরে তাকালে বিবেক হয়তো দেখতে পান, কিভাবে নিজের হাতে সম্ভাবনাময় একটা ক্যারিয়ার ধ্বংস করার সবটুকু আয়োজন সম্পন্ন করেছিলেন তিনি! সাংবাদিকদের সামনে ভরা মজলিশে বিবেক ওবেরয় যখন দাবী করেছিলেন, ঐশ্বরিয়ার সাথে সম্পর্ক রাখার 'অপরাধে' সালমান খান তাকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছেন, তখন সবাই বেশ অবাকই হয়েছিল।

তারকাদের মধ্যে কাদা ছোঁড়াছুড়ি ব্যাপারটা নতুন কিছু নয়। সাবেক প্রেমিকার নতুন প্রেমিককে হুমকি দেয়াটাও খুব বড় কোন ঘটনা নয়, বলিউডে যে লোকজনের হাতের চেয়ে মুখ বেশি চলে, সেটা সবাই জানে। বিবেক হয়তো পাবলিক সিম্প্যাথি পেতে চেয়েছিলেন, চেয়েছিলেন সবার সামনে সালমান খানকে ভিলেন বানাতে। কিংবা সত্যিই হয়তো সালমানের হুমকি গায়ে মেখেছিলেন তিনি, কী হয়েছিল সেটা তিনিই ভালো জানেন। কিন্ত সত্যিটা হচ্ছে, বিতর্কিত সেই সংবাদ সম্মেলনের পরে বিবেক ওবেরয়কেই ভিলেন বানিয়েছে সবাই, সালমানের কিচ্ছু হয়নি, উল্টো বিবেক সব হারিয়েছেন, ক্যারিয়ার, মানুষের ভালোবাসা, এমনকি প্রেমিকা ঐশ্বরিয়াকেও! 

অথচ বিবেকের সঙ্গে এমনটা হবার কথা ছিল না। যেভাবে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন, ২০২০ সালে এসে নায়কদের ভীড়ে সেরাদের সেরার কাতারেই থাকার কথা ছিল তার।

শৈশবে স্কুলবাসের হেল্পারের দিকে তাকিয়ে থাকতেন মুগ্ধ দৃষ্টিতে, বাতাসে লোকটার চুল উড়তো, সেটা দেখতে বড্ড ভালো লাগতো বিবেকের। ছোট্ট বিবেকও দাঁড়াতে চাইতো দরজার সামনের ওই জায়গাটায়, কিন্ত বয়স কম বলে সেখানে দাঁড়াতে দেয়া হতো না তাকে। রেগেমেগে বিবেক ঠিক করেছিলেন, বড় হয়ে বাসের ড্রাইভার হবেন, সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকবেন দরজার সামনে, কে তাকে সরাবে তখন! বন্ধুদের সঙ্গে কাগজের প্লেন বানিয়ে ওড়াতেন। অনেকটা সময় নিয়ে খেটেখুটে বানানো প্লেনটা আকাশে উড়তো বড়জোর পাঁচ সেকেন্ড, তারপরেই গোত্তা খাওয়া ঘুড়ির মতো এসে পড়তো মাটিতে! বিবেক তখন বোঝেননি হয়তো, তার ক্যারিয়ারের গল্পটাও কাগজের বিমানের মতো এমন ক্ষণস্থায়ী হবে! এলাম, দেখলাম, জয় করলামের পরে রাজত্ব না করে হারিয়ে যাওয়াদের ভীড়ে নাম লেখাবেন বিবেক ওবেরয়!

হায়দরাবাদে জন্ম দেয়া বিবেকের সিনেমায় আসাটা কাকতালীয় কিছু নয়। বাবা ছিলেন বলিউডের অভিনেতা, দক্ষিণী সিনেমাজগতেও তার নামডাক ছিল। বাবাই তাকে নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন আলো ঝলমলে এই রংচঙে দুনিয়ায়। কিন্ত বাধ সাধলেন বিবেক নিজেই, বললেন, যেটা করবেন, সেটা নিজের যোগ্যতাতেই করবেন। বাবার ঘাড়ে চড়ে কিছু করার ইচ্ছে নেই তার।

স্কুলে পড়ার সময় শখের বশে দুয়েকটা নাটকে অভিনয় করেছিলেন, অভিজ্ঞতা বলতে এটুকুই শুধু জমা ভাণ্ডারে। নিউইয়র্ক থেকে পড়ে এসেছেন, চোস্ত ইংরেজী ঝাড়তে পারেন। কিন্ত সেসব তো সিনেমায় অভিনয়ের যোগ্যতা নয়! বলিউডের নায়ক হতে গেলে নাচটা ঠিকঠাক জানতে হবে। তাই ফারাহ খানের নাচের ক্লাসে ভর্তি হয়ে গেলেন।

সুদর্শন ছিলেন, প্রথম দেখাতেই নজরে পড়ার মতো। কিন্ত কেউ নজর দিচ্ছিল না তার দিকে, বাবার পরিচয়টা যে আগ বাড়িয়ে দিতে শেখেননি তিনি! নিজের টাকায় হাতখরচা চালাতেন তখন, অনেকগুলো টাকা বেরিয়ে গিয়েছিল কয়েকটা পোর্টফোলিও করাতে গিয়ে। সেগুলো নিয়ে ডিরেক্টরদের অফিসে ছুটতেন, ওয়েটিং রুমে বসে থাকতেন ঘন্টার পর ঘন্টা। কখনও ডাক আসতো, কখনও আসতোই না। কিন্ত ভাগ্যে শিকে ছিঁড়তো না। 

দক্ষিণী এক পরিচালক রামগোপাল ভার্মা নতুন একটা সিনেমা বানাবেন, কেন্দ্রীয় চরিত্রে থাকবেন অজয় দেবগন আর মনীষা কৈরালা। সেকেন্ড লিড রোলের জন্যে একটা ছেলেকে দরকার, গুণ্ডার ক্যারেক্টার। অডিশন দিতে গেলেন বিবেক, রামু তাকে দেখে বললেন, "তোমার তো চকলেট বয় মার্কা চেহারা, রোমান্টিক হিরো হলে ভাবতাম। এই রোলে তোমাকে মানাবে না।" ভগ্নহৃদয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি। মাসখানেক বাদে যখন 'কোম্পানী' নামের সিনেমাটার শুটিং শুরু হলো, তখন সিনেমার সেটে বিবেক ওবেরয়কে দেখা গেল অজয় দেবগনের পাশেই ছাতার নীচে চেয়ারে বসে থাকতে। উশকো-খুশকো চুল, চেহারায় অদ্ভুত একটা কাঠিণ্য, গালে কয়েকদিনের না কামানো খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। রামুর সেই চকলেট বয়ের এ কি হাল!

মাঝখানের গল্পটা বেশ মজার, যদিও এটার সত্যতা কতটুকু সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে। অডিশনে রিজেক্ট হবার দশদিন পরে নাকি বিবেক আবার হাজির হয়েছিলেন রামগোপাল ভার্মার অফিসে, এই দশদিনে গোসল করেছেন মোটে একবার, একই জামা-কাপড় গায়ে, শেভ করেননি এই ক'দিন, গালে তাই দাঁড়ির ছোটখাটো জঙ্গল। শরীর থেকে ঘামের বোটকা একটা গন্ধ বেরুচ্ছে, ঠোঁটে একটা সিগারেট গোঁজা- প্রথম দর্শনে রামু তো চিনতেই পারেননি তাকে! টেবিলের ওপর পা তুলে মুখ থেকে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে মুম্বাইয়ের একদম লোকাল ভাষায় বিবেক নাকি বলেছিলেন- "চান্দুকে দেখতে (কোম্পানী সিনেমায় বিবেকের চরিত্রের নাম) এরকম হলে চলবে?" হা হয়ে থাকা রামুর মুখ থেকে 'হ্যাঁ' ছাড়া আর কিছু বেরোয়নি সেদিন।

সেবছর বলিউডি দর্শকেরা অন্যরকম একটা প্রতিভাকে জন্ম নিতে দেখলো। প্রথম সিনেমাতেই দারুণ স্বতস্ফূর্ত অভিনয় দিয়ে তিনি মন জয় করে নিলেন সবার। সিনেমায় তিনি প্রধান নায়ক নন, তবুও 'চান্দু'ই যেন কোম্পানীর প্রাণ! ফিল্মফেয়ারে সেরা নবাগত অভিনেতা আর সেরা পার্শ্ব অভিনেতার যুগল পুরস্কার জিতলেন বিবেক, কোম্পানীতে অভিনয়ের জন্যে। একই বছর সাথিয়া সিনেমায় অভিনয়ের জন্যে মনোনীত হয়েছিলেন সেরা অভিনেতার পুরস্কারের জন্যেও! 

দিনের শুরুটা সবসময় পুরো দিনের চিত্রটা বলে না। সকালটা সুন্দর মানেই যে দিনটা ভালো যাবে, এমন কথায় ভরসা রাখতে নেই কখনও। বিবেককেই দেখুন না, এমন দুর্দান্তভাবে যে ছেলে যাত্রা শুরু করেছিল বলিউডে, বছর কয়েক বাদেই যে তাকে ব্রাত্য হয়ে থাকতে হবে এই আঙিনায়, সেটা কেউ ভাবতেও পারেনি হয়তো! গ্যাংস্টার বা গুণ্ডার ভূমিকায় তিনি অনবদ্য, সেখানে তার তুলনা তিনি নিজেই। সাঁথিয়া'র রোমান্টিক রোলেও তিনি দারুণ মানানসই, আবার মাস্তি'তে তার কমেডি টাইমিংও একদম পারফেক্ট! এ তো একের ভেতরে অনেক! বিবেক ওবেরয়ের সেরাদের সেরা হওয়া তখন আটকায় কে!

কথায় আছে না, সুখে থাকতে ভূতে কিলায়। সেই ভূতের কিল খেয়েই নিজের পায়ে কুড়াল মারলেন বিবেক। সাবেক বিশ্বসুন্দরী ঐশ্বরিয়া রাইয়ের সঙ্গে সালমানের সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে তখন, এরমধ্যেই 'কিঁউ... হো গ্যায়া না' নামের একটা সিনেমায় কাজ করতে গিয়ে দুজন দুজনের প্রেমে পড়ে গেলেন। স্বাভাবিকভাবেই সেটা ভালোভাবে নেননি সালমান। ঐশ্বরিয়ার সিনেমার সেটে গিয়ে হাঙ্গামা বাঁধিয়ে আসার নজিরও আছে তার। সালমানের কোপানল থেকে বাঁচলেন না বিবেকও, ফোনে তাকে মেরে ফেলার হুমকি দিলেন সালমান, সেটা আবার মিডিয়ার সামনে ফলাও করে বললেন বিবেক। পতনের শুরুটা সেখান থেকেই।

'কিউ হো গ্যায়া না' সিনেমা করতে গিয়েই দুজন দুজনার প্রেমে পড়েন

ব্যক্তিগত সম্পর্ককে প্রকাশ্যে নিয়ে আসার ব্যাপারটা ভালোভাবে নেননি ঐশ্বরিয়া, তিনি যোগাযোগ বন্ধ করে দিলেন বিবেকের সঙ্গে। বিবেকের তখন আম গেল ছালাও গেল অবস্থা। একের পর এক চুক্তিবদ্ধ সিনেমা থেকে বাদ দেয়া হচ্ছিল তাকে, অ্যাওয়ার্ড ফাংশানগুলোতে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছিল না, এমনকি প্রাপ্য পুরস্কারও বাতিল করে অন্য কাউকে দিয়ে দেয়া হচ্ছিল। বিবেক তখন শৈশবের ওই মুখ থুবড়ে পড়া কাগজের প্লেনগুলোর মধ্যে নিজেকে খুঁজে পাচ্ছিলেন হয়তো। সেই সময়টা ভীষণ কষ্টের ছিল বিবেকের জন্যে। একবার ওই ফেলে আসা সময়ের গল্প করতে গিয়ে বলছিলেন-

"আমার মনে হচ্ছিল, যেন আমার ওপরে ফতোয়া দেয়া হয়েছে, এই লোকের সাথে কথা বলা যাবে না, একে সিনেমায় নেয়া যাবে না, যেন আমি অচ্ছ্যুৎ একজন! চারপাশে এত মানুষ, এত কোলাহল, অথচ যেন সেসবের কিছুই অনুভব করতে পারছিলাম না। প্রচণ্ড একাকীত্ব পেয়ে বসেছিল আমাকে। ইন্ডাস্ট্রিতে যাদের বন্ধু মনে করতাম, তারা একে একে ছেড়ে চলে গিয়েছিল আমাকে। আমি জানি না আমার অপরাধটা কী ছিল। আমি একটা বোকামী করেছিলাম, এটা সত্যি। কিন্ত কাউকে খুন তো করিনি!"

তবে নিজের ক্যারিয়ারের মুখ থুবড়ে পড়া বা হুট করেই কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার পেছনে সালমান খানকে কোনদিন দায়ী করেননি বিবেক। তার সাদামাটা জবাব-

"আমার মনে হয় না সালমান নিজে কোনদিন কাউকে বলেছে যে বিবেককে কাজ দিও না বা ওকে এই সিনেমা থেকে বাদ দাও। যেটা হয়েছে, সেটার পেছনে অতি উৎসাহী লোকজনের হাতই ছিল বেশি। আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে চাটুকারীতাটা অনেক বেশি চলে, সবাই ক্ষমতাধারীদের খুশী রাখতে চায়। সেই খুশী রাখার চেষ্টাতেই হয়তো অনেকে আমাকে বলি দিয়েছিল তখন।"

তবে বিবেক ফিরে এসেছিলেন, ওমকারায় তার রোলটা খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, তবুও আলোচনায় ছিলেন তিনি। কিন্ত সবটুকু আলো নিজের দিকে কেড়ে নিলেন পরের বছর। সিনেমার নাম শুটআউট এট লোখান্ডওয়ালা। ভারতে এর আগেও গ্যাংস্টারদের নিয়ে সিনেমা হয়েছে। তাদের ভীড়ে শুটআউট এট লোখান্ডওয়ালা খুব ভিন্ন কিছুও নয়। কিন্ত অন্যরকম একটা ব্যাপার ছিল এই সিনেমায়, সেটার নাম বিবেক ওবেরয়। মায়া ভাই চরিত্রে তার দুর্দান্ত অভিনয় যে দেখেছে, সে না মায়া ভাইকে ভুলতে পারবে, না পারবে বিবেককে মন থেকে মুছতে। 

একটা নেগেটিভ ক্যারেক্টার কখনও মনে ঘৃণার উদ্রেক করছে, আবার পরমূহুর্তেই তার জন্যে করুণার জন্ম নিচ্ছে, এই অদ্ভুত দোলাচালে দুলতে থাকা দর্শকহৃদয় কখন যে মায়া ভাইয়ের প্রেমে পড়ে যাবে, সেটা দর্শক নিজেও বুঝতে পারবে না! সঞ্জয় দত্তের সঙ্গে রেস্টুরেন্টে তার মিনিটকখানেকের কথপোকথনের সেই দৃশ্যটা যতোবার দেখি, ততবারই গায়ে কাঁটা দেয়। মায়া ভাইয়ের ঠোঁটের কোণে ঝুলে থাকা ওই নিষ্ঠুর হাসিটার মধ্যে যেন গা হিম করা একটা ব্যাপার লুকিয়ে আছে! 

'মায়া ভাই' চরিত্রটি যেন তার জন্যই সৃষ্টি হয়েছিল  

প্রশংসিত হলেন, সিনেমা ভালো ব্যবসা করলো, কিন্ত অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি তখনও। শুটআউট এট লোখান্ডওয়ালার পরেও তাই বছরখানেক পুরো বেকার ছিলেন তিনি, কেউ কোন সিনেমার অফার নিয়ে আসেনি তার কাছে। ভাগ্যদেবীও কেন যেন পাশে ছিল না তার। ২০১০ এ করলেন 'প্রিন্স' সি সিনেমাটাই যদি ঋত্বিক বা অন্য কোন নায়ক করতেন, হয়তো ব্লকবাস্টার হিট হতো। বিবেকের অভিনয় দারুণ হলেও দর্শক খুব একটা গ্রহণ করলো না সিনেমাটা। 

ক্যারিয়ারটা যার হাত ধরে শুরু করেছিলেন, সেই রামগোপাল ভার্মা তার কাঁধে হাত রাখলেন এবার। তাকে নিয়ে বানালেন রক্তচরিত্রের দুইটা খণ্ড। প্রথম অংশে বিবেক নায়ক, পরের অংশেই আবার ভিলেন! ভালো আর মন্দের মিশেলে অদ্ভুত একটা চরিত্র, কখনও প্রতিশোধস্পৃহায় কাতর, কখনওবা ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টায় রত। দারুণ অভিনয় করে আরও একবার বিবেক জানান দিলেন, তিনি ফুরিয়ে যাননি! দক্ষিণ ভারতের যে রাজনীতিবিদ পরিতালা রবির চরিত্রে তিনি অভিনয় করেছিলেন, তার পরিবারের সদস্যেরা এলেন বিবেকের সঙ্গে দেখা করতে। বিবেকের নিজের শহর হায়দরাবাদে দারুণ ব্যবসা করলো সিনেমাটার দুটো খণ্ডই, ঘরের ছেলের সিনেমা বলে কথা! 

গল্পটা বদলে যেতে পারতো হয়তো। কিন্ত বদলায়নি। বিবেক আর কখনও বলিউডের গুডবুকে নাম লেখাতে পারেননি। সেই জিলা গাজিয়াবাদ থেকে শুরু করে গ্র‍্যান্ড মাস্তি, কিংবা কৃষ থ্রি'র ভিলেনের রোল থেকে নিয়ে ব্যাংক চোরের পুলিশ অফিসার- বিবেক ওবেরয়ের সংগ্রাম শেষ হয়নি। এতগুলো বছর পেরিয়ে যাবার পরেও তিনি এখনও অনেকের কাছেই অচ্ছ্যুৎ একজন। এজন্যেই তার নামের পাশে ভুরি ভুরি সিনেমা নেই, তাকে অ্যাওয়ার্ড ফাংশানে নিয়মিত নাচতে দেখা যায় না, বলিউডের এতসব দল-উপদলের কোনটাতেই সেভাবে তার জায়গা হয় না। 

অবশ্য এতে বিবেকের নিজের দায়টাও কম নয়। মায়া ভাইয়ের চরিত্রে ফাটিয়ে অভিনয় করা মানুষটা যখন জয়ন্ত ভাই সেজে পর্দায় আসেন, তখন আসলেই হতাশ লাগে। গ্রেট গ্র‍্যান্ড মাস্তির মতো থার্ড গ্রেডের সিনেমায় যখন বিবেক ওবেরয় কমেডির নামে ভাঁড়ামি করার চেষ্টা করেন, তখন মনে হয়, এই বিবেকের অভিনয়ের প্রেমেই কি পড়েছিলাম আমরা? এরমধ্যেও দক্ষিণী সিনেমা ভিভেগামের ভিলেন রোলে তাকে দেখতে পেয়ে আশা জাগে, অভিনয়টা বিবেক ভুলে যাননি এখনও! 'ইনসাইড এজ' ওয়েব সিরিজে তাকে দেখে ফেলে আসা সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায়, যখন আমরা কলার উঁচিয়ে বিবেকের মতো হতে চাইতাম! 

ভাগ্য কিংবা আশেপাশের মানুষগুলো বিবেকের সঙ্গে প্রতারণা করেছে বারবার, তবে বিবেক সেসব মনে রাখেননি। কেউ তার পাশে দাঁড়ায়নি, তাতে তিনি মানুষের পাশে দাঁড়ানো বন্ধ করেননি। ২০০৬ সালে সুনামিতে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া তামিলনাড়ুর একটা গ্রামের সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়েছিলেন তিনি, সেই গ্রামের স্যানিটেশন ব্যবস্থা থেকে শুরু করে বিশুদ্ধ পানি আর বিদ্যুতের ব্যবস্থাও নিজ উদ্যোগে করেছেন, ফসল ফলানোর জন্যে পরিবারপ্রতি অর্থসাহায্য করেছেন, যাদের জমি নেই তাদের দোকান করে দিয়েছেন, মহিলাদের স্বাবলম্বী করার জন্যে গৃহপালিত পশু আর সেলাইয়ের মেশিন কিনে দিয়েছিলেন।

নিজের রিয়েল এস্টেট ব্যবসা আছে, সেখান থেকে একটা অ্যাপার্টমেন্ট তিনি তৈরি করেছেন দায়িত্ব পালনকালে বিভিন্ন দুর্ঘটনায় নিহত পুলিশ অফিসারদের পরিবারের আবাসনের জন্যে। পঁচিশটার বেশি পরিবার থাকে সেই অ্যাপার্টমেন্টে। সিনেমায় সমানে সিগারেট টানতে থাকা বিবেক ওবেরয়ই আবার ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের ধূমপানবিরোধী ক্যাম্পেইনের শুভেচ্ছাদূত! ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্যে হাসপাতাল বানানোর উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি প্রাথমিকভাবে প্রায় আড়াই কোটি রূপির ফান্ড জোগাড় করাও হয়েছে। এরমধ্যে বড় অঙ্কের অনুদান দিয়েছেন তিনি একাই! তবে ফিল্মি ক্যারিয়ারটাকে গোছাতে পারেননি। বিজেপি সমর্থক তিনি, তাই নরেন্দ্র মোদির বায়োপিকে অভিনয় করতে দেখা গেছে তাকে, সেটা প্রশংসার পরিবর্তে বরং হাস্যরসের খোরাক যুগিয়েছে। নিজের পায়ে কুড়াল মারার এই কাজগুলো তিনি না করলেও পারতেন।

ভাগ্য আর পারিপার্শ্বিকতা তার জীবন থেকে অনেকগুলো বছর কেড়ে নিয়েছে, আর আমাদের বঞ্চিত করেছে বিবেকের দুর্দান্ত অভিনয়সুধা থেকে। পুরনো সিনেমাগুলো আবার দেখতে বসলে মনে পড়ে, বিবেক ওবেরয় কতটা শক্তিমান অভিনেতা। গ্যাংস্টার রোলে তার কোন তুলনা আগেও ছিল না, এখনও বোধহয় 'মায়া ভাই'য়ের সমকক্ষ কেউ নেই বলিউডে। একবার একটা সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, গ্যাংস্টারের ক্যারেক্টারগুলোতে তিনি নাকি 'কিক' খুঁজে পান। সম্ভবত বিবেক নিজেও জানেন না, এই চরিত্রগুলোতে কতটা ভালো অভিনয় করতে পারেন তিনি। নইলে কি আর সেধে সেধে কেউ নিজের ক্যারিয়ার খতমের ব্যবস্থা করে...!

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা