একান্ত ব্যক্তিগত কিছু গল্প শেয়ার করলাম। আমার নানা-নানু দুজনই আমাদের সাথে নেই। তাদের জন্য একটু দোয়া করবেন। তারা যেন পরকালে একজন আরেকজনের মাথা খারাপ করে দিতে পারে- আমার এটাই দোয়া।

আজকে আমার নানা-নানুর বিবাহবার্ষিকী। এই দুজন আমার এক জীবনে দেখা সবচেয়ে সুদর্শন জুটি। প্রমান হিসেবে ছবিটা থাকল। তাদের বিয়ের একটা খুব ইন্টারেস্টিং গল্প আছে। মনে হয় গল্পটা বলা যায়।

আমার নানু বেশ দস্যি টাইপের ছিলেন। সেই আমলে শার্ট প্যান্ট পড়তেন। গাছে বেয়ে উঠে পড়তেন। সুতোয় মাঞ্জা দিয়ে ঘুড়ি ওড়াতেন। ঘুড়ি কাটাকাটি নিয়ে একবার এক পাড়ার মাস্তানের সাথে তর্কাতর্কি লাগে। মাস্তান ভয় দেখাতে এগিয়ে আসলে নানু নাকি আম কাটার ছুড়ি তার পেটে চালিয়ে পালিয়ে যায়। পালিয়ে নাকি বড় বোনের বাসা কলকাতাতে চলে গিয়েছিলেন। গল্পটির সত্যতা সম্পর্কে আমি ঠিক নিশ্চিত নই। তবে আমি আমার নানুকে সুপার ওম্যান হিসেবে জানি। এই ঘটনা সত্যি ভেবে আমি অদ্ভুত এক আনন্দ পাই।

আমার নানাও খুব ইন্টারেস্টিং মানুষ ছিলেন। লম্বা চওড়া সুদর্শন এই মানুষটি হয়েছিলেন মিঃ ইস্ট পাকিস্তান! হঠাৎ করে বাবা মারা যাওয়ায় বড় ছেলে হিসেবে পুরো ফ্যামিলির চাপ মাথায় এসে পড়ে। ছোট ভাই বোনদের পড়াশোনা নিশ্চিত করতে তিনি শুরু করেন ৩টি চাকরি। এমন অবস্থায় বিয়ে-শাদির কথা তিনি ভুলেও চিন্তা করতেন না।

অবজার্ভার পত্রিকায় নিজের তৃতীয় চাকরি শেষে বেশ রাত করে রিক্সা করে বাসায় ফিরছেন নানা ভাই। দেখলেন এক বাড়িতে বিয়ের লাইট সাজানো হচ্ছে। সিগারেটে একটা টান দিয়ে তিনি মনে মনে বলেন, কার জানি বিয়ে! বাসায় ফেরার সাথে সাথে তার ছোট ভাই বোনেরা তাকে চেপে ধরে। আক্ষরিক অর্থে তাকে ধরাধরি করে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে হলুদ দিয়ে গোসল করানো শুরু করে। হতভম্ব নানা ভাইকে জানানো হয় আজকে তার বিয়ে। নানা ভাই তখন তার মা’র সাথে একটা চুক্তি করেন। এক শর্তে তিনি এই জোরপূর্বক বিয়েতে রাজি। বিয়ের পর বৌ নিয়ে কোনো কমপ্লেইন তিনি শুনবেন না। তার মা চুক্তিতে রাজি হন। তার বিয়ে হয় সেই বাসাতে, যার সামনে দিয়ে তিনি রিকশা দিয়ে আসতে আসতে বলেছেন, কার জানি বিয়ে!

নানা-নানুর বিয়ের অল্প কিছুদিন পর এক পার্টিতে এক ভদ্রলোক নাকি নানাভাইকে বলছিলেন, মানিক ডাক্তার (নানুর আব্বা)- এর পাগল মেয়েটার নাকি বিয়ে হয়েছে? কে বিয়ে করেছে জানেন? নানা ভাই একটু থেমে উত্তর দিলেন, 'জ্বি জানি, আমি বিয়ে করেছি, আমি।'

আমার নানু-নানার মতো রোম্যান্টিক জুটিও আমি এক জীবনে কম দেখেছি। সারাক্ষন দুইজন ঝগড়া করছেন। কিন্তু একজন চোখের আড়াল হওয়া মাত্রই আরেক জনের কী টেনশন! কই গেল? কেন গেল? বিয়ের শুরুতে নাকি আমার নানা ভাই যখন সকালে উঠে অফিসে যেতেন, নানুকে ঘুম থেকে ডাকতেন না। বরঞ্চ নিজের জন্য রাখা নাস্তা, রুটি ডিম না খেয়ে তা নানুর নাস্তার সাথে রেখে শুধু চা খেয়ে বের হয়ে যেতেন। নানু দেরি করে ঘুম থেকে উঠে সবকিছু দেখে ভাবতেন তার জন্যই নাস্তায় দুই ডিম রাখা!

এরকম নাকি এক বছরের মতো চলে যায়! নানা ভাইয়ের আম্মা পরে নানুকে বলেছিলেন, তোমার একবারও মনে হয় নাই আমার ছেলেটা কী খেয়ে বের হয় সকালে? আমার নানু অকপটে বলেছিলেন, আমার কেন মনে হবে? সে কী খাবে, না খাবে এটা দেখা কি আমার কাজ? নানা ভাই এর আম্মা নানা ভাইকে কমপ্লেইন করার হালকা চেষ্টা করেন। লাভ হয় না। বিয়ের সময়ের ‘চুক্তি’ স্ত্রী সংক্রান্ত যাবতীয় অভিযোগ আটকে দেয়।

আমার নানু, নানা ভাইকে আদর করে ডাকতেন হোম্বাই। এই নামের উৎপত্তি কোথায় বা মানে কী আমি জানি না। তবে এতটুকু জানি নানা ভাই বিয়ের পরপর শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে এক চেয়ারে বসতে গেলে তা ভেঙে যায়। শালা-শালীর কাছে তার নাম হয় চেয়ার-ভাঙা দুলাভাই! এই ঘটনার প্রায় পঞ্চাশ-ষাট বছর পর, তাদের ফ্যামিলির প্রথম নাতিরও শ্বশুরবাড়ির লোকদের সামনে একই ঘটনা ঘটে।

একান্ত ব্যক্তিগত কিছু গল্প শেয়ার করলাম। আমার নানা-নানু দুজনই আমাদের সাথে নেই। তাদের জন্য একটু দোয়া করবেন। তারা যেন পরকালে একজন আরেকজনের মাথা খারাপ করে দিতে পারে আমার এটাই দোয়া।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা