কিছু মানুষ তাকে ভাবতো পাগল, কেউ ভাবতো ভণ্ড। অনেকে ধরেই নিয়েছিলো, গাছের শরীর থেকে লোহা-পেরেক সরিয়ে ব্যবসা করবেন তিনি। ওয়াহিদ সরকার নিরুত্তর। গাছকে তিনি দেখেন সন্তানের চোখে। গত আড়াই বছরে দশ হাজার গাছের শরীর থেকে তিনি তুলেছেন সাড়ে চারশো কেজি পেরেক!

প্রখ্যাত লেখিকা মহাশ্বেতা দেবীর 'হাজার চুরাশির মা' উপন্যাসে একটি বিখ্যাত লাইন ছিলো-

দেয়ালে শ্লোগান তো সবাই লিখতে পারে, কিন্তু সেই শ্লোগান বুকে ধারণ করতে পারে ক'জন?

এই লাইনটি খুব তাৎপর্যপূর্ণ। সে সাথে এই লাইনটি আমাদের যাপিত ভণ্ডামিকেও একবাক্যে চোখের সামনে তুলে দিয়ে যায়। আমরা প্রত্যেকদিন নানা কারণেই অজস্র কথা বলি। এরমধ্যে কয়টা কথা আমরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, সেটার হিসেব করতে বসলে আমরা হয়তো লজ্জাই পেয়ে যাবো। অনেকটা সেরকমই, ছোটবেলা থেকে বিজ্ঞান বইয়ের  'গাছেরও প্রাণ আছে' লাইনটি বলতে বলতে আমরা লাইনটিকে ছিবড়ে চিড়েচ্যাপ্টাই করে ফেলেছি। বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বোসের আবিষ্কৃত এই বিষয়টি নিয়ে আমরা জানি, বলি, লিখি। কিন্তু ধারণ করতে কী পেরেছি কোনোদিন? উত্তর, পারিনি।

একটা গাছ দেখলেই উদাস বদনে সেটার পাতা ছিঁড়ে নেওয়া, গাছের গায়ে লোহা, পেরেক, কাঁটাতার পুঁতে পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন লাগানোর মোচ্ছব করা তো চলছেই। এছাড়াও প্রত্যেকদিন কত গাছ যে দেদারসে কেটে ফেলছি আমরা, কে রাখে তার খোঁজ? আমাদের সামগ্রিক কাজকর্ম বিবেচনায় আমাদের মুখে 'গাছেরও প্রাণ আছে' কথাটা একেবারেই বেমানান ও চুড়ান্ত দ্বিচারিতা ছাড়া আর কিছুই না।

তবে যার মুখে এই কথাটি মানায় এবং যিনি এই কথার সাপেক্ষে কাজ করে যাচ্ছেন আজ অনেকদিন হলো, তিনি আবদুল ওয়াহিদ সরকার। পত্রপত্রিকা, সামাজিক মাধ্যমের সুবাদে অনেকেই তাকে চেনেন। আবার, অনেকেই তাকে চেনেন না। কেউ কেউ পাগল ডাকেন তাকে। কেউ বা আবার সমীহও করেন। তবে তার যে কাজ, সাদা চোখে সেটিকে 'পাগলামি' বলে অনেকের কাছে মনে হলেও, এ কাজটির গুরুত্ব অসীম। আবদুল ওয়াহিদ সরকার রাস্তার পাশের গাছের দেহ থেকে পেরেক, লোহা অপসারণ করেন৷ তিনি বলেন,

গাছের যেহেতু প্রাণ আছে। তাই গাছের গায়ে এগুলো গেঁথে থাকলে, গাছ অবশ্যই ব্যথা পাবে। এটাই স্বাভাবিক।

সেই চিন্তাভাবনা থেকেই আড়াই বছর আগে থেকে তিনি শুরু করেছেন, এ ভিন্নধর্মী কাজ৷

পেশায় রাজমিস্ত্রী এই ষাট বছরের তরুণ মানুষটি ঘুরে বেড়ান দেশের এখান থেকে ওখানে। যেসব জায়গাতে যান, সেসব জায়গার গাছ থেকে পেরেক, লোহা অপসারণ করাই তার একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। তাঁর এ কাজ দেখে প্রথমে তাকে কেউ কেউ ভণ্ড বলতেন। অনেকেই তাকে জিজ্ঞেস করতেন, এই কাজের বিনিময়ে কত টাকা বেতন পান তিনি। অনেকে তো এমনটাও ভেবেছিলেন- গাছ থেকে লোহা, পেরেক তুলে তুলে বিক্রি করবেন দেখেই তিনি এই পেশায় নেমেছেন। কিন্তু মানুষজনের বিচিত্র, বিভ্রান্ত, অবান্তর মতামতকে পাশ কাটিয়ে তিনি তার কাজই করে যাচ্ছেন এখনো। গত আড়াই বছরে যশোর, ঝিনাইদহ সহ কাজ করেছেন সাতটি জেলায়। এখন পর্যন্ত তিনি দশ হাজার গাছ থেকে তুলেছেন সাড়ে চারশো কেজি পেরেক। শুধু যে এ কাজ করেই ক্ষান্ত হয়েছেন তিনি, এমনটাও না। তিনি নিজ উদ্যোগে লাগিয়েছেন অজস্র গাছও।

গাছের শরীর থেকে লোহা-পেরেক সরানোই তার প্রিয় কাজ! 

তাছাড়া গাছ থেকে তুলে আনা লোহা, পেরেক এগুলোকে তিনি ফেলেও দেননি। স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে রেখে দিয়েছেন নিজের বাড়িতেই। জিজ্ঞেস করলে বলেন-

এগুলো স্মৃতি হিসেবে রেখেছি। মাঝেমধ্যে দেখি। আমার ভালো লাগে।

তিনি গাছকে দেখেন সন্তানের মতন। বাবা-মা যেমন সন্তানের গায়ে একটি আঁচড় পড়লেও বিচলিত হয়ে পড়েন, আবদুল ওয়াহিদ সরকারও তেমন ভাবেই দেশের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে ছুটে বেড়ান, নিজের সন্তানদের দেহ থেকে ক্ষতচিহ্ন পরম মমতায় মুছে দিতে। এ বিষয়ে তিনি একরকম যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। তার দাবী, সন্তানদের বাঁচাতে এটা তার একটি যুদ্ধ। এবং এই যুদ্ধ তিনি চালিয়েই যাবেন। পরিবার প্রথম প্রথম তার এই 'ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর কাজ' এ বিরক্ত হলেও পরে মেনে নিয়েছে ওয়াহিদ সরকারের এই কাজকে।

তার এই ভিন্নধর্মী কাজের খবর প্রথম থেকেই বেশ চাঞ্চল্য ফেলেছিলো। দেশের শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্রগুলো শিরোনাম করেছে তাকে নিয়ে। পশ্চিমবঙ্গের পত্রিকাগুলোর প্রচ্ছদেও এসেছেন তিনি। এপার বাংলা- ওপার বাংলা মিলিয়ে তিনি সবার কাছেই এখন এক পরিচিত মুখ।

তবে এগুলো নিয়ে তার কোনো হেলদোল নেই। তিনি তার কাজ নিয়েই মগ্ন। যতদিন না গাছের শরীর থেকে লোহা-পেরেকের অবলম্বনে বিজ্ঞাপনের চিহ্নগুলো মুছে না যাচ্ছে, ততদিন তিনি চালিয়ে যাবেন লড়াই। সেই লড়াইয়ের অংশ হিসেবে আবদুল ওয়াহিদ সরকার বর্তমানে আছেন ঢাকায়। ঢাকার গাছ থেকে ক্ষতচিহ্ন মুছে দিতে সাত জেলা পাড়ি দিয়ে এই 'গাছ-বন্ধু' মানুষটির রাজধানীতে আসা। তিনি ঢাকাতেও প্রিয় সন্তানদের দেহ থেকে ক্ষত মুছতে সফল হবেন, এটাই আশা করি আমরা। সে সাথে তার এই কাজ দেখে অন্তত গুটিকয়েক মানুষের হলেও টনক নড়বে, এটাও কায়মনোবাক্যে থাকবে প্রার্থণা।

বিনম্র শ্রদ্ধা রইলো।

ছবি ও তথ্য কৃতজ্ঞতাঃ বিবিসি বাংলা 

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা