পারভেজ মোশাররফকে ফাঁসির সাজা দিয়েছিলেন তিনি, নাড়িয়ে দিয়েছিলেন দেশটির সেনাবাহিনীর ভিত, বন্দুকের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল তার কলম। পাকিস্তানে ওয়াকার যেটা করেছেন, সেটা বিপ্লবের চেয়ে কম কিছু নয়। সততা আর ন্যায়ের প্রতিমূর্তিতে পরিণত হওয়া এই বিচারকের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে করোনাভাইরাস...

একটা দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হয় সেদেশের সরকার। তবে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রে অনেক কিছুই উল্টোপাল্টা, স্বাভাবিক রাষ্ট্রের সঙ্গে মেলানো যাবে নে এই দেশটাকে। সেখানে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হচ্ছে সেদেশের সেনাবাহিনী। নামকাওয়াস্তে গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা প্রচলিত থাকলেও, সরকারকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করে সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্তাব্যক্তিরা। এমনকি ইমরান খান যে এখন দেশটির প্রধানমন্ত্রী, সেটাও সেনাবাহিনীর আশীর্বাদের কারনেই সম্ভব হয়েছে। পাকিস্তানে সামরিক বাহিনীর ইশারায় কাজ না করলে, তাদের হাতের পুতুল হয়ে না থাকলে প্রধানমন্ত্রীকেও সরিয়ে দেয়া হতে পারে, সবশেষ প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফই যার জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ। মোদ্দাকথা, সেনাবাহিনীর বিরোধিতা করে পাকিস্তানে অন্তত কেউ টিকে থাকতে পারে না, এমনকি সে যদি দেশটির প্রধানমন্ত্রী হয়, তবুও না। 

কিন্ত পেশওয়ার হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ওয়াকার আহমেদ শেঠ ছিলেন ব্যতিক্রমী একজন, একেবারেই অন্য ধাতুতে গড়া একটা মানুষ। সম্প্রতি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ৫৯ বছর বয়সে মারা গেছেন এই বিচারপতি। তার মৃত্যুতে পাকিস্তানের শিক্ষিত সমাজে একটা শোকের ছায়া নেমে এসেছে। সাহসী আপোষহীন এবং সৎ এই মানুষটার অকাল প্রয়াণ ব্যথিত করেছে অজস্র নাগরিককে। তার কথা স্মরণ করতে গিয়ে সবাই একবাক্যে উল্লেখ করছেন, মেরুদণ্ড সোজা রেখে ওয়াকার যেভাবে পাকিস্তানের সবচেয়ে শক্তিশালী প্র‍তিষ্ঠানটির অন্যায় কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করে গেছেন, সেটা পাকিস্তানের বাস্তবতায় অনন্য এক নজির। 

সাবেক সেনাপ্রধান এবং পাকিস্তানের স্বৈরশাসক পারভেজ মোশাররফের ফাঁসির রায়ের কথা মনে আছে? সেই রায় দিয়েছিলেন বিচারপতি ওয়াকার শেঠ। তার নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিশেষ আদালত জেনারেল পারভেজ মোশাররফকে মৃত্যুদন্ড দেন ২০১৯ সালে। মোশাররফ তখন পাকিস্তানের বাইরে। তাকে ২০০৭ সালে সংবিধান স্থগিত করা এবং জরুরি অবস্থা ঘোষণার জন্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। এই রায়ের মাধ্যমে একটা ইতিহাস তৈরি হয়েছিল পাকিস্তানে। এর আগে দেশটিতে কখনও শীর্ষস্থানীয় সেনা কর্মকর্তাদের দেশদ্রোহিতার অভিযোগে শাস্তি হয়নি। 

পারভেজ মোশাররফজে ফাঁসির সাজা দিয়েছিলেন ওয়াকার শেঠ

মোশাররফ অবশ্য বরাবরই নিজেকে নির্দোষ দাবী করে এসেছেন, তিনি বলেছেন, রাষ্ট্রদ্রোহিতার মতো কোন কাজ তিনি করেননি। তাছাড়া দুবাই থেকে পাকিস্তানে ফেরার কোন অভিপ্রায়ও তার নেই, একারনে এই রায় কার্যকর হবে কিনা, এই বিষয়ে সন্দেহ ছিল। ওয়াকার শেঠ তার দেয়া রায়ের একটা অংশে লিখেছিলেন- দণ্ড কার্যকরের আগেই যদি মি. মুশাররফের মৃত্যু হয় তাহলে উচিত হবে "তার মৃতদেহ ইসলামাবাদে পার্লামেন্টের বাইরে টেনে এনে তিন দিনের জন্য ঝুলিয়ে রাখা।" রায়ের এই অংশটা সেনাবাহিনীকে ক্ষুব্ধ করেছিল ভীষণ। আদালতের এই রায়ের বিরুদ্ধে বিবৃতিও দেয়া হয়েছিল সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে, ওয়াকারকে পদচ্যুত করার চেষ্টাও চালানো হয়েছিল। সেযাত্রায় তারা সফল হতে পারেনি। 

একজন সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং সেনাপ্রধান, যিনি লম্বা একটা সময় ধরে দেশ শাসন করেছেন, যার অনুগত লোকজন এখনও সেনাবাহিনীর উঁচু পদে কর্মরত, এবং দেশের মানুষের একটা অংশের কাছেও যিনি জনপ্রিয়- পাকিস্তানের মতো রাষ্ট্রে দাঁড়িয়ে এরকম একজন ব্যক্তিকে ফাঁসির সাজা দেয়ার জন্য বিচারককে কতটা সাহসী হতে হয়, সেটা বলে না দিলেও চলছে। ওয়াকার আহমেদ শেঠের মধ্যে সেই সাহসটা ছিল, কোনকিছুর পরোয়া তিনি করতেন না, না।জীবনের, না চাকরির। সেকারনেই সামরিক বাহিনীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে একের পর এক রায় লিখেছে তার কলম। 

পেশাওয়ারের প্রধান বিচারপতি হিসেবে ২০১৮ সালে দায়িত্ব গ্রহণের কিছুদিন পরই তিনি সামরিক আদালতে গোপন বিচারে অভিযুক্ত দুই শতাধিক বেসামরিক ব্যক্তিকে খালাস করে দিয়েছিলেন। এই আদালতগুলো ২০১৪ সালে পেশাওয়ারের আর্মি পাবলিক স্কুলে পাকিস্তানী তালিবানের চালানো হত্যাকাণ্ডের পর গঠিত হয়েছিল। বিচারপতি শেঠ এই খালাসের কারণ হিসেবে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ না থাকাসহ একাধিক কারণ দেখান। এই রায়টাও সামরিক বাহিনীকে অসন্তুষ্ট করেছিল। 

বিচারপতি ওয়াকার আহমেদ শেঠ

এছাড়াও গত বছর পাকিস্তানের খাইবার-পাখতুনখোয়া প্রদেশে চুপিসারে জারি করা এক আইন বাতিল করে দেন ওয়াকার শেঠ। ওই আইনে সামরিক বাহিনীকে বেসামরিক লোককে বিনা ওয়ারেন্টে গোপন বন্দীশালায় কোন বিচারবিভাগীয় বা প্রশাসনিক নজরদারি ছাড়াই অনির্দিষ্টকাল আটক করে রাখার ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল। আইনটির বাতিল হওয়ায় স্থানীয় জনগন এবং বিরুদ্ধ মতাবলম্বী রাজনীতিবদদের মধ্যে স্বস্তি নেমে এসেছিল। 

আপাদমস্তক বামঘেঁষা মানসিকতার লোক ছিলেন ওয়াকার আহমেদ শেঠ। তার অফিসে জিন্নাহর ছবির পাশাপাশি ঝোলানো থাকতো কার্ল মার্ক্স, লিয়ন ট্রটস্কি আর ভ্লাদিমির লেলিনের ছবি।ছাত্রজীবনে বাম রাজনীতিও করেছেন। তবে আইন পেশায় যুক্ত হবার পরে কোন ধরনের রাজনীতির সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন না, মামলাও লড়তেন বেছে বেছে। এস্টাবলিশমেন্টের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ায় তাকে অনেক ত্যাগই স্বীকার করতে হয়েছে জীবনে। সিনিয়র বিচারপতি হবার পরেও তিন তিনবার তিনি সুপ্রিম কোর্টে নিয়োগ পাননি, কারন দেশটির সামরিক বাহিনী তার ওপর রূষ্ট ছিল। পারভেজ মোশাররফের রায়ের পরে তাকে হুমকি দেয়া হয়েছে, ক্রমাগত তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হয়েছে, তবে সেসবে তিনি মোটেও পাত্তা দেননি, নিজের যুক্তিতে অবিচল থেকেছেন বরাবরই। 

পাকিস্তানে ওয়াকার শেঠ যেটা করেছেন, সেটাকে বিরল নিদর্শন বললেও কম বলা হবে। সামরিক বাহিনীর বন্দুকের সামনে গোটা দেশ যখন নতজানু, তখন তিনি নিজের কলমকে বন্দুকের চেয়েও শক্তিশালী বানিয়ে একের পর এক রায় লিখেছেন তাদের অন্যায় আর অনাচারের বিরুদ্ধে। শত হুমকিতেও তিনি টলে যাননি, পাকিস্তানের বিচার বিভাগের ইতিহাসের সবচেয়ে ঐতিহাসিক রায়গুলোর একটির জন্ম হয়েছে তার হাত ধরে। এটাকে প্রবল বিপ্লব বললেও কম বলা হবে। ওয়াকার শেঠ মারা গেছেন, তার মতো কাউকে পাকিস্তান আর কখনও হয়তো পাবে না। রয়ে যাবে ওয়ান ম্যান আর্মি হয়ে তার অসম্ভব এক লড়াইয়ের গল্পটা... 

তথ্যসূত্র কৃতজ্ঞতা- বিবিসি, ডন।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা