আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কি ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ ছিল?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
যেখানে পাকিস্তানীদের অস্ত্রবিরতির বদলে সারেন্ডার করতে বাধ্য করা জেনারেল জ্যাকব আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের অসামান্য বীরত্বে মুগ্ধ ও নতমস্তকে স্যালুট জানিয়ে বারবার ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সহায়ক শক্তি হিসেবে উল্লেখ করেছেন, সেখানে ভারতীয়দের অনেকে কিভাবে মুক্তিযুদ্ধকে পাক-ভারত যুদ্ধ হিসেবে দেখাতে চায়?
আমাদের স্বাধীনতার লড়াইয়ের একটা পর্যায়ে এসে পাকিস্তান ও ভারত যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। কিন্তু আমাদের মুক্তিযুদ্ধ মোটেও ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ নয়। এমনকি গৃহযুদ্ধও নয়। কারণ ১২ এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হওয়ার পরপর পূর্ব পাকিস্তানের অস্তিত্ব আনুষ্ঠানিকভাবেই বিলুপ্ত হয়। এবং আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণা ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর বলে অনুমোদিত হয় সেই ঘোষণায়, যা এক অর্থে আমাদের প্রথম সংবিধানও। প্রসঙ্গত বলতে হয় গত শতকে শুধু বাংলাদেশই আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়। গোটা বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের পর দ্বিতীয় এবং একমাত্র দেশ বাংলাদেশ।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার নামে মুজিবনগরকে রাজধানী হিসেবে উল্লেখ করে কাগজপত্রে ব্যবহার করলেও বাস্তবে তাদের অবস্থান ছিল কলকাতায়। এবং আমাদের মুক্তিযোদ্ধারাও ভারতেই ট্রেনিং নিয়ে তাদের অস্ত্রের সহায়তা নিয়েই জন্মভুমিতে ফেরে দেশকে মুক্ত করতে। তো পাকিস্তান সরকার এবং তাদের এদেশী অনুচররা (জামাতে ইসলামী-মুসলিম লিগ-নেজামে ইসলামী-পিডিপি) মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতের দালাল (সংক্ষেপে ভাদা) বলে অফিসিয়ালি উল্লেখ করতো। এবং ইয়াহিয়া সরকার প্রায়ই ভারতকে হুমকি দিতো মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য দেওয়া বন্ধ না করলে আক্রমণের। গোলাম আযম তো ঘোষণাই দিয়েছিলো দিল্লীতে গিয়ে ঈদের নামাজ পড়ার, যদিও সে ঈদের পরদিনই পাকিস্তান পালায়।
যা হোক, ২১ নভেম্বর ‘৭১ বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের যৌথ সিদ্ধান্তে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সমন্বয়ে মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ড গঠিত হয়। আর এই কমান্ডের অধিনায়ক ছিলেন লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। যেহেতু বাংলাদেশ ভারতের পূর্ব দিকে তাই পূর্বাঞ্চল অধিনায়ক হিসেবে অরোরা এই দায়িত্ব পান। যদিও ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান ছিলেন স্যাম মানেকশ। এমন সিদ্ধান্তে আসার কারণ যুদ্ধ তখন চূড়ান্ত পর্যায়ের দিকে যাচ্ছিল। এবং সেই লড়াই ভারী অস্ত্রের লড়াই, ট্যাংক-মিগ আর ফ্রিগেটের লড়াই, যার কিছুই ছিল না বাংলাদেশের। থ্রি নট থ্রি, স্টেন, গ্রেনেড এমনকি ভারী মেশিনগানও মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়েছে ভারত। কিন্তু কয়েকশ মিগ, কয়েকশ ট্যাংক আর নৌবহর তো দিতে পারে না। ওগুলা তাদেরই চালাতে হবে। তাই মিত্রবাহিনী গঠন।
৩ ডিসেম্বর বিকেলে ভারতের বিভিন্ন বিমান ঘাটিতে আক্রমণ চালিয়ে পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এই যুদ্ধ চলে দুটো ফ্রন্টে। পূর্ব ফ্রন্টে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হয় মিত্রবাহিনী। আর পশ্চিম ফ্রন্টে শুধু ভারতীয় বাহিনী। পূর্ব ফ্রন্টে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী বাহিনী আত্মসমর্পন করে। জন্ম নেয় স্বাধীন বাংলাদেশ। তাই এই অংশের লড়াই লিবারেশন ওয়ার অব বাংলাদেশ বা বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ বলে উল্লেখিত, যার ব্যাপ্তি ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর। পশ্চিম ফ্রন্টে যুদ্ধ শেষ হয় ১৯ ডিসেম্বর। দ্বিতীয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ (প্রথমটি ১৯৬৫ সালে) তাই ৩ ডিসেম্বর থেকে ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত হিসেব করা হয়।
প্রসঙ্গত বিডিনিউজের হয়ে ঠিক এই প্রশ্নটাই বেশ ক্ষোভ নিয়েই আমি করেছিলাম ভারতীয় জেনারেল জেএফআর জ্যাকবকে। বলেছিলাম- কোনো কোনো মহল আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বলে অভিহিত করে এবং এটা আমাদের অহমে আঘাত দেয়। এ বিষয়ে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী? তার উত্তর ছিলো: আমি সবসময়ই বলে এসেছি এটা তোমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধ, তোমাদের মুক্তিযুদ্ধ, অন্য কিছু নয়।
Pial: The 1971 war is often referred to in different quarters as another Indo-Pak war and some say it was a civil war, and these words hurt our pride. What’s your view on it? Jacob: I’ve always said it was your liberation war. It was your war of independence, not otherwise. Last of all, I want to tell you something. The freedom fighters and the East Bengal Regiment, who with their limited resources fought a mighty regular army, earned the liberation of Bangladesh and it was their love for the country that made them victorious. We helped them, we were brothers in arms. But it was their fight, they fought it. They fought with passion and they achieved what they fought for. I give my heartiest blessings and share the pride for them. They are the gems your country should be proud of!
বিডিনিউজের সাংবাদিক হিসেবে যখন আমি পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে মুক্তিযোদ্ধাদের ভয় দেখিয়ে দ্রুত আত্মসমর্পণে রাজী করানো ভারতীয় জেনারেল জেএফআর জ্যাকবের সাক্ষাৎকার নেই, তখন ঠিক এভাবেই তার প্রশ্নের জবাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সবটুকু কৃতিত্ব দেন জ্যাকব, নতমস্তকে মুক্তিযোদ্ধাদের শ্রদ্ধা জানান এই বীর!
সুতরাং যখন ইন্ডিয়ান আর্মির তথাকথিত ফেসবুক পেইজে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ হিসেবে উল্লেখ করে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিজয় হিসেবে আজকের দিনটা উদযাপন করা হয়, তখন এর মাধ্যমে আসলে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় ছিনিয়ে আনতে যে ৩ হাজার ৬৩০ জন ভারতীয় সেনা সদস্য নিহত হয়েছেন, ২১৩ জন সেনা নিখোঁজ হয়েছেন ও ৯ হাজার ৮৫৬ জন সেনা আহত হয়েছেন, তাদের পুণ্যস্মৃতির প্রতি চরম অপমান ও অশ্রদ্ধা করা হয়। এসব দায়িত্বজ্ঞানহীন জঘন্য আচরণে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি আমাদের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী বর্বরদের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই করবার জন্য সাহায্য করবার অপরাধে যে পরিকল্পিত অন্ধ ভারতবিদ্বেষীতা ছড়িয়ে এসেছে আজ ৪৮ বছর ধরে, তার পালে জোর হাওয়া পাবে। যা একইসাথে প্রবল দুঃখজনক এবং প্রচন্ড হতাশার।
যারা দাবী করেন যে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ আসলে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ, তাদেরকে জেনারেল জেএফআর জ্যাকব কীভাবে বারবার মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনাদের অবস্থান পরিষ্কার করে বলেছেন, সেটা পড়ে দেখার অনুরোধ জানাচ্ছি। ব্যাপারটা অনেকটা এমন হয়ে যাচ্ছে যে, ছেলে বাপকে দুনিয়াদারী শেখাচ্ছে। যেখানে জেনারেল জ্যাকব নিজে যুদ্ধ দেখে, যুদ্ধ করে, আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের অসামান্য বীরত্বে মুগ্ধ ও নতমস্তকে স্যালুট জানিয়ে বারবার ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সহায়ক শক্তি হিসেবে উল্লেখ করেছেন, সেখানে সেই ভারতীয় সেনাবাহিনীর নাম ব্যবহার করে কিছু মানুষ তাদের পূর্বসূরির লিপিবদ্ধ ইতিহাসকে স্রেফ উড়িয়ে দিয়ে তার প্রতি চরম অসম্মান দেখিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে পাক-ভারত যুদ্ধ হিসেবে উপস্থাপন করে খুব জঘন্য এক অপরাধ করেছে।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন