বাংলাদেশ নৌ-বাহিনীর লেফটেন্যান্ট ওয়াসিফ আহাম্মেদ খানকে তাঁর স্ত্রীর সামনে নির্মমভাবে মারা হয়েছে। আর আক্রমণ করেছে খোদ সরকারদলীয় সাংসদ হাজি সেলিমের পূত্র ইরফান সেলিম, তার গাড়ির ড্রাইভার/নিরাপত্তা রক্ষী এবং সাথে থাকা আরো দুইজন ব্যক্তি।

পক্ষে বা বিরুদ্ধ মত যাই-ই থাকুক, এটা স্বীকার করতেই হবে যে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর উপর এখনো মানুষের এক ধরনের অগাধ আস্থা রয়েছে এবং এই তিন বাহিনীকেই বাংলাদেশের শক্তির একটা বড় অংশ বলে মনে করা হয়। আমরা যে বাহিনীগুলোকে এমন সর্বোচ্চ শক্তিধর মনে করি সেই বাহিনীর সদস্যদের গায়ে কেউ হাত তোলে কিংবা এবিউজ করে, এটা আমাদের মেনে নিতে কষ্ট হয়। 

এই ধরনের ক্ষেত্রে এক ধরনের আস্থার সংকটও তৈরী হয়। মানুষের ভেতর চট করে এই ভাবনাটা চলে আসে এমন যে, আর্মি অফিসার দেশে নিরাপদ না, তাহলে আমরা কোন ছার! এই ভাবনাটা বড় ভয়াবহ।

বাংলাদেশ নৌ-বাহিনীর লেফটেন্যান্ট ওয়াসিফ আহাম্মেদ খানকে তাঁর স্ত্রীর সামনে নির্মমভাবে মারা হয়েছে। আর আক্রমণ করেছে খোদ সরকারদলীয় সাংসদ হাজি সেলিমের পূত্র ইরফান সেলিম, তার গাড়ির ড্রাইভার/নিরাপত্তা রক্ষী এবং সাথে থাকা আরো দুইজন ব্যক্তি।

আক্রমণটা এতটাই ভয়াবহ ছিলো যেখানে এই সামরিক অফিসারের নীচের পাটির একটি দাঁত পড়ে যায়। যে ভিডিওটি গত ১২/১৩ ঘন্টা ধরে ঘুরছে সেখানে স্পষ্টত দেখতে পাওয়া যায় এই অফিসারের ঠোঁট রক্তাক্ত। ইনফ্যাক্ট তখনও ব্লিডিং হচ্ছে বলে মনে হচ্ছিলো।

মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, লেফটেন্যান্ট ওয়াসিফ নীলক্ষেত থেকে বই কিনে মোটরসাইকেলে করে মোহাম্মদপুরের বাসায় ফিরছিলেন। সঙ্গে তাঁর স্ত্রীও ছিলেন। 

ল্যাবএইডের সামনে তাঁকে আক্রমণ করা হয়

ল্যাবএইড হাসপাতালের সামনে তার মোটরসাইকেলটিকে পেছন থেকে একটি গাড়ি ধাক্কা দেয়। ওয়াসিফ আহমদ মোটরসাইকেল থামিয়ে গাড়িটির গ্লাসে নক করে নিজের পরিচয় দিয়ে ধাক্কা দেওয়ার কারণ জানতে চান। 

তখন এক ব্যক্তি বের হয়ে তাকে গালিগালাজ করে গাড়ি চালিয়ে কলাবাগানের দিকে আসেন। মোটরসাইকেল নিয়ে ওয়াসিফ আহমদও তাদের পেছনে পেছনে আসেন।

কলাবাগান বাসস্ট্যান্ডে গাড়িটি থামলে ওয়াসিফ মোটরসাইকেল নিয়ে গাড়ির সামনে দাঁড়ান। তখন তিন-চার জন লোক গাড়ি থেকে নেমে বলতে থাকে, ‘তোর নৌবাহিনী/সেনাবাহিনী বাইর করতেছি, তোর লেফটেন্যান্ট/ক্যাপ্টেন বাইর করতেছি। তোকে আজ মেরেই ফেলবো। এই বলে তাকে কিলঘুষি দিতে থাকে। এরপর তারা পালিয়ে যায়।’

মেজর সিনহা হত্যার ঠিক পর পর এমন একটা ঘটনার নানা রকমের ডাইমেনশন আছে। সাধারণ মানুষের ভেতর এক ধরনের ভয় ধরে গেছে এমন যে, এই দেশে সিনহার মত এমন চৌকশ অফিসারকে এমন অবলীলায় মেরে ফেলে যায় কিংবা লেফটেন্যান্ট ওয়াসিফের মত এস এস এফ এর অফিসাররের ওপেন রাস্তায় দল-বল নিয়ে মুখে ঘুষি দিয়ে দাঁত ফেলে দেয়া যায়, সেখানে বোধকরি সাধারণ জনতা একেবারেই তুচ্ছ।

লেফটেন্যান্ট ওয়াসিফ

শুধু নৌ-বাহিনীর অফিসার বলেই না, একবার ভাবুন তো একজন স্ত্রীর সামনে তাঁর স্বামীকে এইভাবে মারলে, এইভাবে নির্যাতন করলে এই ভয়াবহ অপমানের স্মৃতি নিয়ে এই মানুষটিকে আজীবন পথ চলতে হবে। আমাদের এই দেশীয় কালচার অনুযায়ী এখনো স্বামী কিংবা পিতা, স্ত্রী অথবা সন্তানের কাছে অনেকটা সবচাইতে শক্তিধর আর আস্থার যায়গা। এভাবে রাস্তায় স্বামীকে কয়টা নেড়ি কুত্তার মত সন্ত্রাসীদের কাছে অপদস্থ  হতে দেখলে একজন স্ত্রী কীরকম ট্রমায় ভুগতে পারেন, ভেবে দেখেছেন ব্যাপারটা?

লেফটেন্যান্ট ওয়াসিফ চিৎকার করে বলছিলেন, 'আমি দেশকে সার্ভ করি। আমার নিরাপত্তা রাষ্ট্র না দিতে পারলে আমি এই চাকরি থেকে রিজাইন করব"। আমার কানের ভেতর বেজে চলছে ছেলেটির এই কথা।

মেজর সিনহার হত্যাকান্ডের ঠিক পরপর জুনিয়র অফিসারদের বড় গ্রুপগুলো নিজেদের ভেতর এই কথাই বলছিলো যে, সিনহার এই অবস্থাই যদি হয়, যদি সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের অপমানিত হতে হয় এইভাবে রাস্তা-ঘাটে তাহলে চাকুরি ছেড়ে দেয়াটাই উত্তম। এই আলোচনার সম্পর্কে আমাকে অভিহিত করেছিলেন সামরিক বাহিনীতে থাকা আমার একজন সূত্র।

একটি রাজনৈতিক দল প্রায় ১৩ বছর ক্ষমতায়। তাঁদের অন্তত এইটুকু বুঝা উচিৎ এতবছর ক্ষমতায় থাকলে এমনিতেই আমাদের মত অঞ্চলে এক ধরনের অষন্তোষ তৈরী হয়। মানুষ মনে এক দলীয় শাসনের নাআনবিধ সূত্র মেলাতে মেলাতে প্যানিক ছড়ায়। ফলে রাজনৈতিক দল্টির হওয়া উচিৎ আরো বেশী জনতা বান্ধব, আরো বেশী উদার এবং আরো বেশী লিবারেল।

অথচ আমি সরকারের মধ্যে এক ধরনের স্টাবর্ন আচরণের চিহ্ন দেখি। এক একজন এম পি, মন্ত্রী, মন্ত্রী পূত্র কিংবা তাদের কেরানীর দাপটে মানুষের নাভিঃশ্বাস উঠে যাচ্ছে।

আমাদের মত যারা সরকার সমর্থক তারা আর কত পারি এইভাবে একটা ঘটনা ঘটবে এবং সরকারের দ্রুত নেয়া ব্যবস্থায় করতালি দিয়ে বগল বাজিয়ে বলতে, 'সরকারকে ধন্যবাদ দ্রুত ব্যবস্থা নেবার জন্য'। এইসব বলতে বলতে ক্লান্ত লাগে। ক্লান্ত মানে অনেক ক্লান্ত লাগে।

চোখের সামনে অন্যায়গুলো এত স্পষ্ট এবং এত নির্মম যে, এটিকে সমর্থন না করেও এর কয়েকমাইল দূর দিয়ে গেলেও নিজেকে অপরাধী মনে হয়।

সামনে নির্বাচন আসছে। সরকারের টানা ১৫ বছরের শাসনের পর এই নির্বাচনে আমি মানুষের মধ্যে চরমতম অষন্তোষ দেখতে পাচ্ছি। মানুষ হাস-ফাঁস করছে। মনে হয় কী একটা অস্বস্তি সবার ভেতর। আমি তো চাই, আমার দল ক্ষমতায় থাকুক যুগের পর যুগ আর এই দেশটাকে স্বপ্নের সোনার বাংলা করে দিক।

কিন্তু এই কি সোনার বাংলা? রাস্তা ঘাটে আর্মি অফিসারদের ধরে হত্যা, স্ত্রী সামনে আর্মি অফিসারের দাঁত ফেলে দেয়া, পুলিশ হেফাজতে খুন করে ফেলা মায়ের দীর্ঘ অনশন, দল-বল বেঁধে সরকার দলীয় লোকেরা গৃহ বধুকে ধর্ষন তারপর সেটিকে রাষ্ট্র করে দেয়া, বাজারে দ্রব্যমূল্যের নাভিঃশ্বাস গতি!

এটা কি সোনার বাংলা? আমি আওয়ামীলীগ, আওয়ামীলীগের আদর্শ ধারণ করি। বঙ্গবন্ধু আমার নেতা। ফলে আমি এই পতন কিংবা পতনের শব্দে ভেঙ্গে যেতে থাকি। এই দলটার হাইব্রিড চিন্তক হতাম, সমর্থক হতাম, গায়ে লাগতো না। কিন্তু আমার গায়ে লাগে। 

দলটাকে তো ভালোবাসি। দলটার এই প্রতিদিনের মধ্যযুগের দিকে যাত্রা আমার মেনে নিতে বড় কষ্ট হয়।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা