দর্শকেরা তাকে চেনে দেশের সবচেয়ে স্টাইলিশ খল অভিনেতা হিসেবে, যার বজ্রকন্ঠের হুংকারে সবাই নড়েচড়ে বসতেন...
২০০৪ সাল, ঈদের আগের দিন, চারদিকে উৎসবের আমেজ, কিছুক্ষণ পরেই উঠবে ঈদের চাঁদ। সেই সময়েই টেলিভিশনের পর্দায় ভেসে উঠলো বিশিষ্ট খল অভিনেতা রাজীব আর নেই। অসুস্থ ছিলেন অনেক দিন ধরেই, শরীরে বেঁধেছিল ক্যান্সারের বাসা। হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। তাঁর সেই রোগাক্রান্ত ভগ্ন চেহারার সাথে কেউই তাকে মিলাতে পারছেন না।
দর্শকেরা তাকে চেনে দেশের সবচেয়ে স্টাইলিশ খল অভিনেতা হিসেবে, যার বজ্রকন্ঠের হুংকারে সবাই নড়েচড়ে বসতেন। সেই তেজোদৃপ্ত মানুষটির এমন অসহায়ত্ব হতবাক করে দিয়েছিল, ক্যান্সারের সাথে না পেরে জীবনের মায়া ছাড়িয়ে পরলোকে পাড়ি জমিয়েছিলেন আজকের এই দিনে।
পুরো নাম ওয়াসিমুল বারী রাজীব, প্রথম সিনেমা 'রাখে আল্লাহ মারে কে'। কাজী হায়াতের হৃদয়স্পর্শী সিনেমা 'খোকন সোনা' তে মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। তবে ক্যারিয়ার গড়েন খল অভিনেতা হিসেবে, পুরো আশির দশক জুড়েই একের পর এক খল চরিত্রে অভিনয় করে জনপ্রিয়তার শীর্ষে এসেছিলেন। 'ভাত দে' সিনেমার চালের মিলের সেই দুশ্চরিত্র মালিক কিংবা হীরামতি সিনেমার সেই খল চরিত্র থেকে রঙ্গীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা, অবুঝ হৃদয়, সাজানো বাগান, গর্জন, সত্য মিথ্যা সহ অনেক সিনেমা।
নব্বইয়ের দশকে এসে খল চরিত্রে নিজেকে আরো পরিণত করেন, বলা যায় নিজেকে আরো সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। বিশেষ করে কাজী হায়াতের দাঙ্গা, ত্রাস, চাঁদাবাজ, দেশদ্রোহী, লুটতরাজ সিনেমাগুলোতে দুর্দান্ত খল অভিনয় দিয়ে নিজেকে অনন্য করে তুলেছিলেন। 'দাঙ্গা' সিনেমায় 'আমি মাইন্ড করলাম' সংলাপটি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, উনার মুখে অনেক সংলাপই জনপ্রিয় হয়েছিল। 'শেষ খেলা' সিনেমাতে তো তিনি খল হয়েও প্রধান নায়ক, 'সুন্দর সন্ধ্যায় এই গান দিলাম উপহার' গানটিতো এখনো শ্রোতাপ্রিয়।
'কেয়ামত থেকে কেয়ামত' সিনেমার মাধ্যমে অনেক বছর তিনি খল চরিত্রের বাইরে অভিনয় করেছিলেন, সিনেমার পাশাপাশি তিনিও এই চরিত্রে জনপ্রিয় হয়ে যান। দুর্দান্ত খল থেকে তিনি হয়ে যান কখনো আদর্শ বাবা, কিংবা দায়িত্ববান বড় ভাই। যার উদাহরণ দেখতে পাই অন্তরে অন্তরে, স্নেহের প্রতিদান, শেষ ঠিকানা, লাভ সিনেমাগুলোতে। 'দেমাগ' সিনেমায় ব্যতিক্রম চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন।
অমর নায়ক সালমান শাহর সঙ্গে বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল, দুইজনেই জুটি বেঁধে বেশ সংখ্যক সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন। ছাত্র রাজনীতির সিনেমা 'বিক্ষোভ' এ দুইজনের দ্বন্দ্বই যেন সিনেমাটিকে আরো উপভোগ্য করে তুলেছিল। তার মুখে 'রাজনীতিতে একটা কথা আছে' সংলাপটিতো এখনো মানুষের মুখে ঘুরে ফিরে।
কেয়ামত থেকে কেয়ামতের পর 'দেনমোহর' সিনেমাতে সালমান শাহর বাবার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। 'প্রানের চেয়ে প্রিয়' সিনেমায় দুর্ধর্ষ ডাকাত চরিত্র থেকে ধর্মপ্রাণ ব্যক্তির চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। 'বাবার আদেশ, ভালোবাসা কারে কয়' সিনেমা দুটিও উনার বর্নাঢ্য ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা সিনেমা। চাষী নজরুল ইসলামের 'হাঙর নদী গ্রেনেড' সিনেমায় যেমন স্বাধীনতাকামীর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন, তেমনই 'মেঘের পরে মেঘ' সিনেমায় করেছিলেন রাজাকারের চরিত্র।
'হীরামতি' সিনেমার জন্য প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। এরপর একে একে দাঙ্গা, বিদ্রোহ চারিদিকে, সাহসী মানুষ চাই দিয়ে মোট চারটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। আশি ও নব্বই দশকে আলাদা করে খল বিভাগ চালু থাকলে আরো জাতীয় পুরস্কার পেতেন সুনিশ্চিত। অনেকের মতে রাজনীতিতে যোগদান, এফডিসির দায়িত্ব পেয়ে তিনি খল ইমেজটাকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, যার কারনে সেই সময় শুধু পজেটিভ চরিত্রে বেশি মনোনিবেশ করেছিলেন। বন্ধু মিজু আহমেদের সঙ্গে 'ফ্রেন্ডস মুভিজ' নামে প্রযোজনা সংস্থা খুলেছিলেন, যেখান থেকে একে একে নির্মিত হয় মহৎ, আসামী গ্রেফতার, চালবাজের মত সিনেমা।
বাংলাদেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে তিনজন সেরা খল অভিনেতার নাম নিলে, তারমধ্য উনি একজন। ১৯৫২ সালে জন্মগ্রহন করা এই কিংবদন্তি মৃত্যুবরণ করেছিলেন মাত্র ৫২ বছর বয়সে, আজ উনার ১৬তম মৃত্যুবার্ষিকী। আজও তাকে দেওয়া হয়নি একুশে পদক।
বাংলা চলচ্চিত্রের এই প্রবাদপ্রতিম অভিনেতার প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা। আপনার আত্মার শান্তি কামনা করি। ওপারে ভালো থাকবেন রাজীব!
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন