কেরালার এক নবদম্পতির পোস্ট ওয়েডিং ফটোশ্যুট ভাইরাল হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। সেই সাথে 'কথার তরবারি' নিয়ে নেমে পড়েছে হতাশাগ্রস্ত নেটিজেনরা। নোংরা, ক্লেদাক্ত, অসুস্থ মন্তব্যে তারা বিষিয়ে দিচ্ছে সব! কিন্তু কেন? অন্যকে নিয়ে নোংরা মন্তব্য করার কী অধিকার আছে তাদের?
মানুষ জাতির একটা খুব বড় সমস্যা, এরা অন্যকে নিয়ে চর্চা করতে খুব ভালোবাসে। সকালে, দুপুরে, বিকেলে, রাতে বিভিন্ন মানুষকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা না করলে কেন যেন উদরের অন্ন অক্ষত থেকে যায়, সেটি আর পরিপাক-কর্মে অংশ্রগ্রহণ করতে পারে না। ফেসবুক থাকার কারণে সুবিধা হয়েছে আরো। সমালোচনা করতে এখন আর বাইরেও নামা লাগেনা। ঘরের সশব্দ ফ্যানের নীচে আরামে শুয়ে-বসে-কাত হয়েই যাপিত সমালোচনা করা যায়। ট্রল করে, মক করে ভাইরাল করা যায় সব। আদিমকাল থেকে মানুষের মধ্যে গেড়ে বসা পরনিন্দা পরচর্চার এ সমস্যা জাতীয় না, আন্তর্জাতিক। এই সমস্যার আরেকটি উদাহরণই পেলাম সম্প্রতি।
দক্ষিণ ভারতের কেরালার এক দম্পতির বিয়ের খবর নিয়ে তুমুল চর্চা চলছে সোশ্যাল মিডিয়াগুলোতে। আপনারা কেউ কেউ হয়তো জানেনও বিষয়টি নিয়ে। লক্ষ্মী ও হ্রুশি কার্তিকের এই আলোচিত বিয়ে হয়েছে পারিবারিক সম্মতিতেই। হ্রুশি এখন একটি টেলিফোন কোম্পানিতে চাকরি করেন। লক্ষ্মী সবেমাত্র ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি সম্পন্ন করেছেন। গত বছরে দুই পরিবারের সদস্যরা মিলিত হন এবং বিয়ের তারিখ ঠিক করেন। কিন্তু বিয়ের তারিখে লকডাউন পড়ে যাওয়ায় স্থগিত হয়ে যায় অনুষ্ঠান। সেপ্টেম্বরে লকডাউন একটু শিথিল হয়ে গেলে অনাড়ম্বরভাবেই হয়ে যায় তাদের বিয়ে। করোনার ভয়, পুলিশের কড়াকড়িসহ আরো কিছু সমস্যা... সবমিলিয়ে এ বিয়েতে উপস্থিত হন মাত্র পঞ্চাশজন!
এই দম্পতি বিয়ের আয়োজনে একটু হতাশ হলেও চাচ্ছিলেন বেশ সুন্দর করে একটি পোস্ট ওয়েডিং ফটোশুট করবেন৷ এজন্যে বিয়ের পরে দুজনে মিলে পরিকল্পনা করে চলে যান এক চা বাগানের রিসোর্টে। সাথে নিয়ে যান তাদের ফটোগ্রাফার বন্ধুকে। ইন্টারনেট থেকে ফটোশ্যুটের থিম সিলেক্ট করেন। এরপর হোটেল থেকে একটি সাদা সিল্কের চাদর নিয়ে তারা চলে যান চা-বাগানের মধ্যে। ফটোশ্যুট করার জন্যে। কয়েক ঘন্টার মধ্যে ফটোশ্যুট হয়ে যায়। চা বাগান, শুভ্র পোশাক ও হাসিমুখের দুটি যুবক-যুবতী, অসাধারণ কনসেপ্টের এই ছবিগুলো যখন পরবর্তীতে ফেসবুকে আসে, ভাইরাল হয়ে যায় খুব অল্পসময়ের মধ্যেই। অনেকেই পছন্দ করেন নবদম্পতির ভালোবাসার এ তীব্র প্রকাশকে। কিন্তু অনেকেরই শুরু হয় জ্বলুনি। নববিবাহিত দম্পতিকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে করে পুরো বিষয়টিকেই নোংরা, ক্লেদাক্ত বানিয়ে ফেলেন তারা। কেন কাপড় কম পড়লো, এভাবে সব দেখাচ্ছে কেন, লাজলজ্জা কিছু নেই, এদের পর্ণোছবি করা উচিত..নানারকম কথাবার্তায় মুখর হলো নেটিজেনের একাংশ! তবে অনেক নেটিজেন আবার এই দম্পতিকে অকুন্ঠ সমর্থনও দিলেন। ভালোবাসার এমন সাহসী প্রকাশকে ইতিবাচকভাবেই দেখেছেন তারা। তারা খুশি, এভাবেও যে কেউ 'পোস্ট ওয়েডিং ফটোশ্যুট' কল্পনা করতে পারে, তা ভেবে।
এই দম্পতিও সাহসের ভালোই পরিচয় দিয়েছেন। তারা ছবিগুলো আর সরাননি তাদের ব্যক্তিগত একাউন্ট থেকে। অবশ্য ছবিগুলো সরালে যে মানুষজনের নোংরামি কমতো না, তা তো একরকম নিশ্চিত। ছবি না সরানোর পেছনে এই দম্পতির বক্তব্যও বেশ পরিষ্কার-
আমরা কোনো পাপ করিনি, তাই ছবি সরানোর প্রশ্নই ওঠেনা। তাছাড়া ছবি সরানো মানেই এই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়া। সেটা আমরা করবো না। আমাদের বাড়ি থেকেও আমাদের বলা হয়েছিলো, এরকম ছবি না তুললে কী এমন ক্ষতি হতো? আমরা তাদেরকেও বুঝিয়েছি।
মাঝেমধ্যে ভাবি, মানুষ আসলে এতটাই হতাশ, রসহীন ও লাইফলেস হয়ে গিয়েছে যে কোথায় কার ফটোশ্যুট, কোথায় কার ব্যক্তিগত জীবন, সেগুলো নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে তাদের এখন সময় পার করতে হচ্ছে, সুখ পেতে হচ্ছে। এতটাই নিকৃষ্ট পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে এখন মানুষ যে, যাকে নিয়ে যা খুশি মন্তব্য করে যাচ্ছে। মানুষের 'বিবেক' নামক বস্তুটি কী আদতেই আছে? নাকি সেটি কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে? নাকি সেটিকে অন্য কোনো লকারে বন্ধ করে দিয়ে এসে এসব করছে মানুষজন?
ভেবে উত্তর খুঁজে পাই না আসলেই।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন