সিলেটে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আত্মসমর্পন করে ১৫ ডিসেম্বরে। কর্ণেল ওসমানী সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তাহলে ষোলোই ডিসেম্বরে রেসকোর্সে কেন তিনি উপস্থিত ছিলেন না?

'ওসমানী কেন আত্মসমর্পন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না'- এই মর্মে বহু প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হয়েছে। যদিও মূল কারণটা হচ্ছে আর্মি প্রটোকল। তাজউদ্দিন আহমেদ যদি ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি হিসেবে নিযোগ না দিতেন, তাহলে সিনিয়ারিটি অনুযায়ী বাই ডিফল্ট পদটা পেতেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার, কারণ তিনিই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সবচেয়ে সিনিয়র অফিসার এবং একই সঙ্গে উপ-সেনাপ্রধান। অন্যদিকে ওসমানী তখনও কর্ণেল এবং তাকে জেনারেল হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় ১৬ ডিসেম্বরের পর। যা হোক তারপরও তিনি আমাদের প্রধান সেনাপতি এবং ভারতীয় বাহিনীর প্রধান স্যাম মানেকশর সমানই তার মর্যাদা ছিলো তখন। 

অন্যদিকে অরোরা একজন আঞ্চলিক প্রধান। পূর্ব ফ্রন্টের অধিনায়ক। যেমন লে. জেনারেল নিয়াজীও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্ব ফ্রন্টের অধিনায়ক। পূর্ব ফ্রন্টের জন্য গঠিত মিত্রবাহিনী তাই অরোরার কমান্ডেই হবে সেটাই স্বাভাবিক। ওসমানী কেন সই করবেন? পাকিস্তানের পক্ষে কি তাদের সেনাপ্রধান সই করেছিলো? আত্মসমর্পন অনুষ্ঠানে কি স্যাম মানেকশ ছিলেন? তাহলে ওসমানী কেন যাবেন?

এই প্রশ্নে জ্যাকবের উত্তর ছিলো: There is a lot of propaganda about it. The fact is, he was in Sylhet. He was in a helicopter that was shot at by the Pakistan army. I had ordered everyone on the Bangladesh side to stay in Kolkata. But he rode the chopper, got shot and couldn't attend the ceremony. It's not our fault. He should have been there. We wanted him there. Khandker (deputy commander-in-chief AK Khandker) attended in his absence. 

জ্যাকবের কথাটা সত্যনিষ্ট নয়। এ প্রসঙ্গে ওসমানীর ভাষ্যটা বরং আমরা শুনি : যুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের অধীনে মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তরে জনসংযোগ কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন নজরুল ইসলাম। একাত্তরের রণাঙ্গন অকথিত কিছু কথা নামে এক স্মৃতিচারণে তিনি তুলে ধরেছেন এর বিশদ বিবরণ। ঘটনা হচ্ছে ১২ ডিসেম্বর ওসমানী কলকাতা থেকে আগরতলা হয়ে মুক্তাঞ্চল সিলেটে যান। এটা নিশ্চিত করেন মুক্তিবাহিনী হেডকোয়ার্টারের অফিসার ইন চার্জ জেনারেল ওসমানীর বিশ্বস্ত বন্ধু মেজর এমআর চৌধুরী। তার ভাষায়- 

তানী এখন সিলেট গেছুন।  ১৮ ডিসেম্বর সদর দপ্তরে ফিরে তাকে নিয়ে এসব গুজব শুনে ভীষণ ক্ষুব্ধ হন ওসমানী। তার মন্তব্য ছিলো: দেখুন আমরা স্বাধীনতা অর্জন করতে যাচ্ছি। কিন্তু দুঃখ হলো স্বাধীন জাতি হিসেবে আমাদের মধ্যে আত্মমর্যাদাবোধ সম্পর্কে কোনো চেতনা এখনও জন্ম হয়নি। আমাকে নিয়ে রিউমার ছড়ানোর সুযোগটা কোথায়? কোনো সুযোগ নেই। তার অনেক কারণ রয়েছে। নাম্বার ওয়ান- পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কবে আত্মসমর্পণ করবে আমি জানতাম না। আমি কলকাতা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর তাদের আত্মসমর্পণের প্রস্তাব এসেছে। নাম্বার টু- ঢাকায় আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে আমার যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ এই সশস্ত্র যুদ্ধ ভারত-বাংলাদেশের যৌথ কমান্ডের অধীনে হলেও যুদ্ধের অপারেটিং পার্টের পুরো কমান্ডে ছিলেন ভারতীয় সেনাপ্রধান লেফট্যানেন্ট জেনারেল স্যাম মানেকশ। সত্যি কথা হচ্ছে আমি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কোনো নিয়মিত সেনাবাহিনীর সেনাপ্রধানও নই। আন্তর্জাতিক রীতিনীতি অনুযায়ী পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমার কাছে আত্মসমর্পণ করতে পারে না। কারণ বাংলাদেশ জেনেভা কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী কোনো দেশ নয়। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে জেনারেল মানেকশকে রিপ্রেজেন্ট করবেন লে.জে অরোরা। জেনারেল মানেকশ গেলে তার সঙ্গে যাওয়ার প্রশ্ন উঠতো।

সার্বভৌম সমতার ভিত্তিতে আমার অবস্থান জেনারেল মানেকশর সমান। সেখানে তার অধীনস্থ আঞ্চলিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল অরোরার সফরসঙ্গী আমি হতে পারি না। এটা দেমাগের কথা নয়। এটা প্রটোকলের ব্যাপার। আমি দুঃখিত, আমাকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। আমাদের মধ্যে আত্মমর্যাদাবোধের বড় অভাব। ঢাকায় ভারতীয় বাহিনী আমার কমান্ডে নয়। জেনারেল মানেকশর পক্ষে জেনারেল অরোরার কমান্ডের অধীন। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করবে যৌথ কমান্ডের ভারতীয় বাহিনীর কাছে। আমি সেখানে (ঢাকায়) যাবো কি জেনারেল অরোরার পাশে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখার জন্য? হাও ক্যান আই! আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করবেন জেনারেল মানেকশর পক্ষে জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা আর পাকিস্তানী বাহিনীর পক্ষে জেনারেল নিয়াজী। এখানে আমার ভূমিকা কি? খামোখা আমাকে নিয়ে টানা হ্যাচড়া করা হচ্ছে!

পাশাপাশি কেনো মুক্তিবাহিনীর কাছে পাকিস্তানীরা আত্মসমর্পণ করেনি এটার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন ওসমানী, সংক্ষেপে ব্যাপারটা এমন যে যুদ্ধবন্দীদের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক নীতিমালা আছে যার অন্যনাম জেনেভা কনভেনশন। বাংলাদেশ এই কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ নয় বলেই সেই নীতিমালা মানতে মুক্তিবাহিনী বাধ্য ছিলো না। তাই তাদের হত্যা করলে বা তাদের উপর অত্যাচার করলে বলার থাকতো না কিছু। পাকিস্তানীরা জেনেশুনে সে ঝুকি নেয়নি। তাছাড়া ৯০ হাজার যুদ্ধবন্দীকে খাওয়ানো পড়ানো তদারক করার ক্ষমতাও যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের ছিলো না। তখনও নিজের খাওয়াটাই যে জোটে না! (তথ্যসূত্র : একাত্তরের রণাঙ্গন অকথিত কিছু কথা লেখক: নজরুল ইসলাম, অনুপম প্রকাশনী ১৯৯৯) 

তো ওসমানী সিলেটে কি করেছেন? হেলিকপ্টারে গুলি ছোড়ার কাহিনী একটা গল্প বটে। কারণ তাতে ওসমানী আহত হননি। আগরতলা দিয়ে ওসমানী কুমিল্লা হয়ে সিলেটে ঢোকেন। কুমিল্লা থেকে হবিগঞ্জ যাওয়ার পথেই তার কপ্টারে গুলি ছোড়া হয় বলে কথিত আছে। যাহোক ১২ তারিখ তিনি হবিগঞ্জে মুক্তাঞ্চল সফর করেছেন।

সিলেটে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আত্মসমর্পন করে ১৫ ডিসেম্বরে। ওসমানী সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ১৫ ডিসেম্বর মুক্ত সিলেটে ওসমানী কথা বলছেন দুই সেক্টর কমান্ডার লে.কর্নেল সিআর দত্ত এবং লে.কর্নেল মীর শওকত আলীর সঙ্গে এমন একটা ছবি ওসমানীর নিজের স্মৃতিকথাতেই প্রকাশিত। কথা বলছেন দুই সেক্টর কমান্ডার লে.কর্নেল সিআর দত্ত এবং লে.কর্নেল মীর শওকত আলীর সঙ্গে-

আর তিনি আত্মসমর্পনের দায়িত্বে থাকা মিত্র বাহিনীর ভারতীয় অফিসারদের অভিনন্দন জানাচ্ছেন সে ছবিটাও আছে তার উপর প্রকাশিত সেই বইয়ে (ও জেনারেল, মাই জেনারেল)। এমনকি মিত্রবাহিনী গঠন ও অনুমোদন তার সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতেই হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের সঙ্গে স্যাম মানেকশর বৈঠকে তিনিও ছিলেন। এমনকি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তা অনুমোদন দেয়ার অধিকারী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সঙ্গে বৈঠকেও।

এখন আসা যাক প্রশ্নের মধ্যে প্রচ্ছন্ন ও গোপন প্রশ্নটায়। ভারতীয় জেনারেল সই করেছেন যে দলিলটায় সেটায় কি পাকিস্তান ভারতের কাছে আত্মসমর্পন করেছে? উত্তর না। করেছে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ডের কাছে। সেই এখতিয়ার বাংলাদেশ সরকার অরোরাকে দিয়েছে। আত্মসমর্পনের যে দলিল সেটা ইনস্ট্রুমেন্ট অব সারেন্ডার নামে পরিচিত। সেটার বাদিকে নীচে অরোরা যেখানে সই করেছেন, সেখানে কি লেখা দেখেন তো? লেখা: জেনারেল অফিসার কমান্ডার ইন চীফ ইন্ডিয়ান অ্যান্ড বাংলাদেশ ফোর্সেস ইন দ্য ইস্টার্ন থিয়েটার।

এরপরও যদি উত্তর না পান, তাহলে আর কিছু বলার নেই...

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


ট্যাগঃ

শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা