জেমস সাইডিস: যার আইকিউ ছিলো নিউটন-আইনস্টাইনের চেয়েও বেশি!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
মানবসভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে মেধাবী মানুষ ধরা হয় তাকে, আইকিউ ছিল নিউটন-আইনস্টাইনের চেয়েও বেশি! তার হওয়ার কথা ছিলো অনেক কিছু, অথচ হতে পারেননি কিছুই৷ যিনি পৃথিবীকে বদলাতে চেয়েছিলেন, অথচ পৃথিবীই যাকে বদলে দিয়েছিল পুরোপুরি...
লাইমলাইটের তলায় আসার সবারই অদম্য আগ্রহ। সবাই-ই চায়, মানুষ তাকে চিনুক। অন্ধকার থেকে একটু আলো, জনস্রোতের মাঝে একটু "স্বীকৃতি" পেলে মন্দ হয় না মোটেও। কিন্তু লাইমলাইটের তলায় আসার পরের জীবনটা মোটেও স্বস্তির না, বরং নিরন্তর অস্বস্তির। প্রত্যাশার চাপ, লাইমলাইটের কটকটে দ্যুতি এবং মানুষের কৌতূহলী চোখের সামনে বেঁচে থাকা ভীষণ কষ্টকর৷ এমন এক প্রতিভাবান মানুষের গল্প বলবো আজ, যিনি খুব অল্পসময়ের মধ্যেই পাদপ্রদীপ খুঁজে পেয়েছিলেন। কিন্তু এরপরের গল্পটা ক্লান্তির। ক্রমাগত প্রত্যাশার চাপ যাকে ক্রমশ সংকুচিত করেছে, করেছে বিব্রত, বিপর্যস্ত, শঙ্কিত। আজকে সে মানুষটির গল্পই শোনা যাক বরং।
প্রথমেই জানা যাক, ইউক্রেন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আসা এক দম্পতির কথা। বোরিস সাইডিস এবং সারাহ সাইডিস দুইজনেই ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। দুইজনেই ডাক্তার। বোরিস সাইডিস, হার্ভার্ড থেকে পড়াশোনা করে সাইকোলজিস্ট হন। এবং সারাহও বেশ অল্পসময়ের মধ্যেই আমেরিকান মেডিকেল ডিগ্রি পেয়ে যান। এখানে একটা বিষয় জেনে রাখতে হবে, সারাহ এমন এক সময়ে ডাক্তার হয়েছিলেন, যে সময়ে আমেরিকার মহিলারা ভোট দেয়ারও সেভাবে অধিকার পেতেন না। এবং তাঁর সময়ে তিনিই ছিলেন আমেরিকার একমাত্র ডিগ্রিধারী মহিলা ডাক্তার। যাই হোক, বরিস এবং সারাহ'র সংসার জীবন চলছিলো। অসম্ভব মেধাবী এই দু'জন মানুষের কোল আলো করে ১৮৯৮ সালে জন্ম নেন উইলিয়াম জেমস সাইডিস। যাকে বলা হয় "স্মার্টেস্ট ম্যান ইন দ্য হিস্ট্রি।" এবং যাকে শেষে এসে মনে রাখেনি কেউই। আজকের গল্প এই বিস্মৃতপ্রায় মানুষটিকে নিয়েই।
কেউ একটু বুদ্ধিদীপ্ত আচরণ করলেই আমরা সাধারণত "লোকটা দেখি আইনস্টাইন" বলে ঠাট্টা করি। "জিনিয়াস" বললেই সবার চোখে সম্ভবত প্রথমেই আইনস্টাইনের জিহ্বা বের করা ভেংচিকাটা চেহারাই ভেসে ওঠে। অবশ্য তার পেছনে সঙ্গত কারণও আছে। গড়পড়তা মানুষের আইকিউ যেখানে ৮৫ থেকে ১১৫ এর মধ্যে ঘুরপাক খায়, সেখানে আইনস্টাইনের আইকিউ ছিলো ১৬০! আবার আইনস্টাইনের চেয়েও বেশি আইকিউ ছিলো নিউটনের, ১৯০! ভাবছেন, লিখতে বসেছি উইলিয়াম জেমস সাইডিসকে নিয়ে। এরমধ্যে আইনস্টাইন, নিউটনকে টেনে আনা কেন আবার? কারন আছে। আমাদের এই উইলিয়াম জেমস সাইডিসের আইকিউ কত বলতে পারেন? তাঁর আইকিউ ছিলো ২৬০! স্বাভাবিক গড়পড়তা মানুষের প্রায় তিনগুন!
যাই হোক, জন্মের পর থেকেই সাইডিসের বিস্ময়কর কার্যকলাপ দেখা যাচ্ছিলো। মাত্র ১৮ মাস বয়সেই সাইডিস "নিউ ইয়র্ক টাইমস" পত্রিকা পড়া শুরু করেন। ৮ বছর বয়সে সে ল্যাটিন, গ্রিক, ফ্রেঞ্চ, রাশিয়ান, হিব্রু, টার্কিশ, জার্মান ও আর্মেনিয়ামসহ ৮টি ভাষা শিখে ফেলেন। এখানেই থামেননি তিনি। নিজেই আবিষ্কার করেন একটি ভাষা। নাম দেন Vendergood. এবং একটি বইও লেখেন এই ভাষায়। বইয়ের নাম ছিলো- দ্য বুক অব ভেন্ডারগুড।
নয় বছর বয়সে সাইডিসের বাবা-মা তাকে হার্ভার্ডে ভর্তি করানোর তোড়জোড় শুরু করে। কিন্তু হার্ভার্ড কর্তৃপক্ষ সাফ জানিয়ে দেন, এত কম বয়সের শিক্ষার্থীকে তারা নিতে পারবেন না। অবশ্য এরই দুই বছর পরে, ১১ বছর বয়সে সাইডিস ভর্তি হন হার্ভার্ডে। সবচেয়ে কম বয়সে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ "হার্ভার্ড" এর ছাত্র হবার যে রেকর্ড এখনো ভাঙ্গতে পারেনি কেউ। এখানে ভর্তি হবার প্রথম কিছুদিনের মধ্যে শিক্ষকদেরকেই পড়াশোনার বিভিন্ন বিষয়ে বোঝানো শুরু করেন সাইডার। এভাবেই চলছিলো।
মাত্র ১৬ বছর বয়সে "ব্যাচেলর অব আর্টস" এ পড়াশোনা শেষ করে হার্ভার্ড থেকে বের হন তিনি। স্বভাবতই মিডিয়ার ক্যামেরাগুলো তাঁর দিকেই থাকতো বরাবর। ছোটবেলা থেকে এসব বিষয়ে মুখ না খুললেও, এবার বিরক্তি প্রকাশ করেন তিনি। বলেন-
I want to live the perfect life. The only way to live the perfect life is to live it in seclusion. I have always hated crowds.
সব রকমের জনপ্রিয়তা, জনসমাগম এড়িয়ে চলা শুরু করেন তিনি। পরিবারের সাথেও যোগাযোগ কমিয়ে দেন৷ অঙ্কের শিক্ষক হিসেবে এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অল্প বেতনে চাকরীও করেন কিছুদিন৷ পরিবারের সাথে দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছায়৷ সেটা এতটাই মারাত্মক আকার ধারণ করে, বাবার মৃত্যুর পর শোকসভায়ও যাননি জেমস সাইডিস। নিজেকে দূরে রাখেন সবকিছু থেকে।
একের পর এক চাকরী ছাড়ছিলেন। থিতু হতে পারছিলেন না কোনোখানেই। কেরানী পেশা থেকে শুরু করে যখন যা পাচ্ছিলেন, সেটাই করছিলেন। মোটকথা, পালিয়ে বেড়াতে চাইছিলেন লাইমলাইট, ফেইম, সাকসেস থেকে। কিন্তু, যেতে চাইলেই কী যাওয়া যায়? মিডিয়া আবার তাকে খুঁজে বের করে একসময়ে। শুরু হয় ট্রল, আবার। বিশ্বের সবচেয়ে বুদ্ধিমান মানুষটি কেন কেরানীর চাকরী করছে, তার কী আসলেই কোনো প্রতিভা আছে... এসব নিয়ে ক্রমাগত মিডিয়ার মুখরোচক গল্প চলতে থাকে। "চাইল্ড প্রডিজি" নামে যাকে ডাকা হতো, তাঁর কেন এ অধঃপতন, তা নিয়েও পত্রিকাগুলো চালাতে থাকে অপপ্রচার। এদিকে সাইডিস তখন আরো ঢুকে যাচ্ছেন খোলসের মধ্যে। ক্রমাগত যুদ্ধ করছেন নিজের সাথে। আশেপাশের সাথে৷
এরপর সবকিছু ছেড়েছুড়ে হয়ে গেলেন সমাজতন্ত্রবাদী৷ বোস্টনে একবার বিক্ষোভ করার সময়ে পুলিশের হাতে হলেন গ্রেফতার৷ কোর্টে উঠলেন। হয়ে গেলো আঠারো মাসের জেল। যদিও পরিবারের মানুষজন তাকে জামিনে ছাড়িয়ে আনে কিছুদিন পরেই। কিন্তু সাইডিস আবার পালিয়ে গেলেন সবকিছু ছেড়েছুড়ে। একাকীত্ব জীবনে হারিয়ে গেলেন সবকিছু থেকে, দূরে।
এবারের জীবনটা আরেকটু কষ্টের। কাঠ কেটে, কায়িক পরিশ্রম করে রুটিরুজির সংস্থান করছিলেন। কারো সাথেই যোগাযোগ রাখছিলেন না৷ জনজীবন থেকে নিজেকে একরকম "ব্রাত্য" করেই স্বেচ্ছানির্বাসনে কাটাচ্ছিলেন জীবন। তখন আবার আঘাত। সেই যে ছোটবেলায়, মাত্র ১৮ মাস বয়সে "নিউ ইয়র্ক টাইমস" পড়া শুরু করেছিলেন, সেই পত্রিকাই তাকে বিদ্রুপ করে ছাপালো লেখা "এপ্রিল ফুল।" এপ্রিল মাসের এক তারিখে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সাইডিস। সেটাকে কটাক্ষ করে, হাসিঠাট্টা করে তাঁর প্রতিভা, তাঁর ব্যক্তিগত জীবন সবকিছুকে ফর্দাফাই করে, চূড়ান্ত অপমান করে তারা সংবাদ ছাপালেন।
সাইডিস বরাবরই চুপ ছিলেন। এবার আর নিতে পারলেন না৷ কোর্টে মামলা করলেন নিউ ইয়র্ক টাইমস' এর বিরুদ্ধে৷ অবশ্য ফলাফল দেখে যেতে পারলেন না। মাত্র ৪৬ বছর বয়সে সেরেব্রাল হ্যামারেজ হয়ে মারা গেলেন এই প্রতিভাবান মানুষটি।
যাপিত জীবন থেকে পালাতে চাওয়া বা পালিয়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা নেহায়েত কম না। "ইনটু দ্য ওয়াইল্ড" সিনেমায় ক্রিস সবকিছু ছেড়েছুড়ে নিজেকে সঁপে দেন অরণ্যে। আমেরিকার বিখ্যাত লেখক জে ডি স্যালিঞ্জার খ্যাতির চূড়া থেকেই ঝাঁপ মারেন নিস্তব্ধতার গহীন সাগরে। জনজীবন থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখেন জীবনভর। সেরকমই গল্পটা উইলিয়াম জেমস সাইডিসের। কাটাতে চেয়েছিলেন একাকী জীবন৷ কিন্তু পারলেন কই? লাইমলাইটের তলা, প্রত্যাশার পারদ আর "অসাধারণ" তকমা তাকে চেপে রাখে আমৃত্যু। একটা জীবন কাটিয়েছেন মানুষ, মানুষের প্রশ্নবাণ, মানুষের কটাক্ষে জর্জরিত হয়ে৷ অথচ চেয়েছিলেন ঠিক তার উল্টো। হলো কই?
উইলিয়াম জেমস সাইডিসের হয়তো ক্ষমতা ছিলো পৃথিবী বদলানোর৷ অথচ শেষমেশ পৃথিবীই তাকে বদলে দেয় পুরোটা! এভাবেই ক্ষয়ে ক্ষয়ে নিঃশেষ হয়ে যায় এক "উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক।" যার হওয়ার কথা ছিলো অনেক কিছু। অথচ দিনশেষে এসে হতে পারেননি কিছুই৷
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন