যে নারী দেশ গড়ে, তার নিরাপত্তা কেন এই ভূখণ্ড দিতে পারে না?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
একের পর এক সামাজিক, ধর্মীয় মৌলবাদ, রাষ্ট্রীয় গুন্ডাতন্ত্র, শিশ্নধারী শুয়োরপনা সবার আক্রোশ মোকাবেলা করে যে নারী দেশ গড়ে, দেশ বানায় সমানে সমান; তার পথচলার রাস্তা এত ঝুঁকিময় কেন?
ডঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল সাস্টের এক পাঠচক্রে একটা কথা বলেছিলেন। পুরোটা প্যারাফ্রেইজ করলে হয়- বাংলাদেশের বহু ছেলে বিদেশে গিয়ে দেশে ফেরার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। একটু সুযোগ আর সম্মানজনক ক্যারিয়ার হলেই ফিরে আসতে চায় ডিগ্রী শেষে। কিন্তু বাংলাদেশের চৌকাঠ একবার যে মেয়ে পেরোয়, সে আর কখনো ফিরতে চায় না। ওকে তুমি যত প্রলোভনই দেখাও না কেন!
কারণ আমরা আমাদের মেয়েদের এত যন্ত্রণা দিই। জন্মের পর থেকে এই দেশের চারপাশ এত প্রতিকূল তাদের জন্য- সমস্ত আবেগ, ইচ্ছা সব চাপা দিয়ে মেয়েরা তাই দেশের বাইরে থাকতে চায়। কেবল ওইটুকু মুক্ত আবহাওয়ার জন্য। কাজেই কেউ দেশের বাইরে গেলে, আবেগে দ্রবীভূত হয়ে দেশে ফিরতে চাইলে- আগে তোমাদের নিজের পার্টনারকে জিজ্ঞেস করে নেয়াটা উচিত।
উনি নিজেই ইয়াসমিন ম্যাডাম রাজি হওয়ার পরেই দেশে ফিরেছিলেন। এটা বলেছিলেন। আমার মনে হয়, এই কথার সাথে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই একমত হবেন।
বাংলাদেশ নামক দেশটি তার নাগরিকের জন্য শ্বাপদসংকুল একটা জনপদ। গুটিকয়েক এলিট আর সরকারি পাওয়ার বাবলের মানুষ বাদে সবাই থার্ড ক্লাশ সিটিজেনের চাইতেও বাজে অবস্থায় দিননিপাত করে। কিন্তু সবচেয়ে ভালনারেবল আর সবচে' বেশি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে নাগরিকের নারী অংশটি। অথচ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন হয়েছিল নারীদের সীমাহীন ত্যাগ আর তিতিক্ষার বিনিময়ে। খোদ মুক্তিযুদ্ধের সময়েও বিদেশে পিআর ক্যাম্পেইন হিসেবে বাংলাদেশ তার ধর্ষিতা নারীদের ছবি আর জীবন কাহিনী ব্যবহার করেছে।
ট্যাংকের সামনে শাড়ি পরিহীতা বোন রোশনারা বোমা ফাটিয়ে জয় বাংলা বলে আত্মহুতি দিয়েছেন, এমন ফিকশনকে সত্য কাহিনী বানিয়ে পিআর ক্যাম্পেইন চালানো হয়েছিল কলকাতায়। লেখক সুনীল গাংগুলি বলেছিলেন- ওই ঘটনাকে সত্য মনে করেই- কোলকাতায় শোরগোল পড়ে, সমস্ত ভারতীয় কবি সাহিত্যিকরা রাস্তায় নামেন। উনি নিজেও বিদেশে চিঠি লিখতে শুরু করেছিলেন।
উনার চিঠি পাওয়া এলেন গিনসবার্গের 'সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড' কবিতায়ও বার বার ওই নারী শিশুদের, বিশেষতঃ নারীদের ভোগান্তির কথা এসেছে। (যদিও বাঙালীদের অনুবাদে মায়ের কান্না, মায়ার বিষন্ন চোখ বাদ যায় কেন মাঝেমধ্যে, এটা বিস্ময়কর)।
আমেরিকার সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডির উপরে লেখা এক আর্টিকেল পড়ছিলাম- সেখানে মিসেস কেনেডির রেফারেন্স দিয়ে বলছিল- শরনার্থী বিশেষতঃ নারীদের দূরাবস্থার ছবি দেখে উনারা বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। নিজের দেশ আমেরিকার পররাষ্ট্র নীতির বিরুদ্ধে গিয়ে।
শুধু মুক্তিযুদ্ধের সময়ই বাংলাদেশের নারীরা পিআর ক্যাপিটাল হোন নাই। যুদ্ধের পরেও পাকিস্তান যখন লাশের হিসাব চাপা দিচ্ছিল, ম্যাসিভ ওয়ার ক্রাইমস ডিনাই করছিল, তখন তাদের বিরুদ্ধে ফ্যাক্টস রিবাটাল হয়েছিল- এইসব ধর্ষিত নারীরা। তাদের মাস প্র্যাগনেন্সি আর যুদ্ধশিশু সন্তানেরা। পাকিস্তান বলছিল এই যুদ্ধে ২০-২১ হাজারের বেশী নিহত হয় নি। আর সাকূল্যে ১০০-২০০ জনের বেশী ধর্ষণের শিকার হয় নি। আমাদের খুবই পুওর ডকুমেন্টেশন স্ট্র্যাটেজিতে লাশের হিসাব প্রমাণ করা মুশকিল ছিল। কিন্তু পাকিস্তানের ডাহা মিথ্যাকে রুখে দিয়েছিল ধর্ষণের হিসাব। WHO, IPPF প্রভৃতি আন্তর্জাতিক সংস্থা দেখলো, এখানে পাকিস্তান বর্ণিত ১০০ বা ২০০ নয় - যুদ্ধের পর লাখ লাখ নারী গর্ভপাত করাতে আসছে।
অস্ট্রেলিয়ান ডাঃ জিওফ্রে ডেভিস দেখলেন- কেবল তার ক্যাম্পেই মাসে ৫ হাজার নারীর এবোরশন হয়েছে। তার সহকর্মীদের সাথে রিসার্চের ভিত্তিতে বিশ্ববাসীকে জানালেন- ধর্ষিতার সংখ্যা পাকিস্তানের বলা ১০০-২০০ নয়। বাংলাদেশের দাবী অনুযায়ী ২ লক্ষও নয়।
বরং বহু ধর্ষিতা প্রকাশ্যে আসছেন না লোকলজ্জায়। তাদের রিসার্চ অনুযায়ী সংখ্যাটা ৩ লাখের বেশী। কেবল ৩ মাসেই ৩০ হাজার যুদ্ধ শিশুর জন্মের সূত্র স্বীকার করে স্বয়ং জাতিসংঘের নির্মিত রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার।
এরপর থেকেই নারী নির্যাতনকে অন্যতম সাইনবোর্ড বানিয়ে- বাংলাদেশ ফ্যাক্টস ভিত্তিক ওয়ারফ্যারে পাকিস্তানকে হারিয়ে সারা বিশ্বে বিশ্বাসযোগ্য হতে থাকে। নিজের যুদ্ধের ডকুমেন্টেশনের খামতি এড়ানোও গেল বোধহয়। এরপর, স্বীকৃতি ও অনুদান লাভের ক্ষেত্রেও অনেক বড় নিয়ামক ছিল এটি। অর্থ্যাৎ বাংলাদেশ তার জন্মের জন্য আউটস্ট্যান্ডিংলি নারীদের কাছে বহুলাংশে ঋণী। মা-বোনের ধর্ষণের সিমপ্যাথিকে ক্যাপিটাল করে, সে দেশ স্বীকৃতি আদায় করেছিল। সেই দেশ এখন ধর্ষনের অভয়ারণ্য! তাছাড়া, যুদ্ধে যে পুরুষ শহীদ হয়েছে, তার বিধবা স্ত্রী, পুত্রহীনা মা, নিরাপত্তাহীন বোন- এই দেশের সবচে' ভালনারেবল ভিক্টিম ছিলেন। ওই আলাপ নাই করলাম এখানে। স্বাধীনতার আলাপ তো করলাম।
স্বাধীনতার ২০ বছর পর বাংলাদেশ যে ইকোনমিক টেইক অফ করে, সেটি হচ্ছে গার্মেন্টসের দর্জিগিরির উপর ভর করে। সেই উন্নতির সোপানের সিঁড়িটি মেয়েদের পাজরের উপর তৈরি। এই লাখ লাখ শ্রমিকের ৮৫% হচ্ছেন নারী শ্রমিক। সস্তা শ্রমের সেরা সেলাইয়ের প্রলুব্ধতামার্কা সাইনবোর্ড দেখিয়ে সাদা সাদা মানুষের ডলার আসে বুড়িগঙ্গার তীরে। সেই ইনক্রেডিবল-অর্থনীতির ১০ জনে ৮ জন নারী। অথচ সেই টাকায় মাতুব্বরি করে গোটা দেশ বড়লোকি চাল মারে।মোল্লারা এই মেয়েদের জেনার কারখানা বলে গালি দেয়। শুকরছানারা চলতি পথে ধর্ষণ করে।
এবার আসি আরেক হিসাব। আজকের যে পুরুষ শ্রমিক বিদেশে কামলা খেটে ঘাম রক্ত করে পয়সা পাঠায়, তার চাকুরীর জিম্মাদার হচ্ছে নারী শ্রমিক। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো অলিতখিতভাবে পুরুষ শ্রমিক নেয় এই শর্তে- যে নারী শ্রমিক সে দেশে পাঠানো হবে। সৌদি আরব তো সরকারের সাথে লিখিত আকারে চুক্তির দাসখত নিয়ে এইভাবে নারী শ্রমিকের বিনিময়ে পুরুষ শ্রমিক নেয়। মানে অর্থনৈতিক যে সমস্ত পিলারের উপর বাংলাদেশের ইজ্জত দাঁড়িয়ে, সেখানে নারী বোঝা না। বরং ডাইনামিক স্টেইকহোল্ডার।
আগামীতে যে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের উপর ভর করে দেশ মধ্য আয়ের দেশ হইতে চায়। যে শিশুরা দেশকে বড়লোক বানাবে বলে বুলি মারি। তাদের ৬০% প্রাথমিক শিক্ষকও নারী। মিলেনিয়াম দশকের পর যে সমস্ত কম মুজুরী পাওয়া ৬০% প্রাথমিক শিক্ষিকারা একটা জাতির সন্তান মানুষের দায়িত্বে লেগে আছেন, তাদেরকেও রেইপ করতে চায় এই জাতি।
আজকের সাত সমুদ্দুর দূরে আমি, দেশে বিদেশে যতটুকুই পড়াশুনা করছি। তার প্রতিটি সার্টিফিকেটে কিশোরী বয়সে ৮ মাইল পায়ে হাঁটা, দুইবার নদী পেরোনো প্রাইমারি স্কুলগামী আমার মায়ের পদচিহ্ন লেগে আছে।
রাষ্ট্রের জন্মমুহুর্ত থেকে আজকের বিকাশমান জাতি রাষ্ট্র; অর্থনীতির যে ২-৩টা স্ট্রং স্যুটের উপর বাংলাদেশের ইজ্জত বড়লোকি নির্ভর করবে আগামীতে, সেগুলো নিজের গায়ে জড়িয়ে দেশকে তৈরি করে দিচ্ছে এই নারীরা। এবং অনেকটা স্বেচ্ছায়, নিজেরা উদ্যোগী হয়ে। নানা সীমাবদ্ধতা আর হা হতোম্মি প্যারোকিয়াল কালচারের কাঁটা পেরিয়েই।
একের পর এক সামাজিক, ধর্মীয় মৌলবাদ, রাষ্ট্রীয় গুন্ডাতন্ত্র, শিশ্নধারী শুয়োরপনা সবার আক্রোশ মোকাবেলা করে যে নারী- দেশ গড়ে, দেশ বানায়, সমানে সমান; তার পথচলার রাস্তা এত ঝুঁকিময় কেন? সেই মেয়েরা কতটুকু নিরাপদ ভাববে এই ভূখন্ডকে? বাংলাদেশ রাষ্ট্রের হিপোক্রেসি, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ইতরপনার সুলুক সন্ধান- ওই একটি বিবেচনাবোধের উপরেই নির্ভর করবে আজকেও, আগামীতেও।
ছবি কৃতজ্ঞতা- ফোর্বস, শাহানা নিশা।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন