একটা মেয়ে মরেও শান্তি পাবে না? তবু রেহাই নেই?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
আমরা সবাই কমবেশি হতাশায় ভুগি। একজন কেউ হতাশায় মরে গেলে আমরা সবাই তখন কয়েকদিন হতাশাগ্রস্থদের উদ্দেশ্যে ডাক ছাড়ি- ‘ওরে কে কোথায় ডিপ্রেশনে ভুগছিস, আমার বুকে আয়। মনের কথা বল।’ কিন্তু এভাবে আসলে হয়না...
একটা অল্প বয়সী মেয়ে আত্মহত্যা করেছে। আমি তাকে চিনি না। তবে মেয়েটার নামটা এত সুন্দর যে আমি তার নাম জেনে মুগ্ধ হয়েছি। এইরকম নাম যে পরিবার রেখেছে, সেটি অবশ্যই শিক্ষিত সংস্কৃতিমনা পরিবার। তাই মেয়েটি নিজেও তার নামের মতো আলাদা, আর দশজনের মতো হবে না, ধরে নেয়া যায়। হয়তো খুব অসাধারণ নয় সে। কিন্তু যতটুকু জানলাম, সে নিজের মতো চলত, নিজের ইচ্ছেমত জীবনযাপন করত।
মৃত্যুর পর আমরা সবাই মৃত ব্যক্তিকে নিয়ে সুন্দর সুন্দর কথা লিখি। একমাত্র ‘মেয়েমানুষে’র অল্পবয়সে মৃত্যু এবং সেটি যদি অপঘাতে হয়, তাহলে আমরা মনের সুখ মিটিয়ে মেয়েটাকে নিয়ে খারাপ খারাপ কথা লিখি। লিখি, কারণ এটি আমাদের অবদমিত জাতির চরিত্রের এক অতি সাধারণ বৈশিষ্ট্য।
যে মেয়েটি মরে গেছে, তাকে নিয়ে আপনি ভালো কথা খুঁজে পাচ্ছেন না? তাহলে কিছুই না লিখুন। কিন্তু এমন কোনো খারাপ কথা কেন লিখছেন, যা তার ব্যক্তিগত জীবনের সাথে সম্পর্কিত? কেন আপনি তাকে জাজ করছেন? কীভাবে আপনি জানেন মেয়েটির ব্যক্তিজীবন আপত্তিকর? আর আপনার কাছে আপত্তিকরের সংজ্ঞাই বা কী? আপনার কাছে তার পোশাক আপত্তিকর? তার যৌনজীবন, সম্পর্কের ধরণ আপত্তিকর? তার চলা-বলা-হাঁটা আপত্তিকর? কিন্তু কেন?
আপনি কীভাবে জানেন আপনি যেভাবে কথা বলেন, যা পরেন, যা লেখেন, যা খান, যেভাবে প্রেম করেন, যেভাবে শোন- সেটাই যথার্থ? এই যথার্থতা কে মাপে? আপনাকে দিয়ে কে মাপায়? মেয়েটিকে জাজ করার যে দাঁড়িপাল্লা, সেটি আপনার হাতে কে তুলে দিল?
আমরা সবাই কমবেশি হতাশায় ভুগি। একজন কেউ হতাশায় মরে গেলে আমরা সবাই তখন কয়েকদিন হতাশাগ্রস্থদের উদ্দেশ্যে ডাক ছাড়ি- ‘ওরে কে কোথায় ডিপ্রেশনে ভুগছিস, আমার বুকে আয়। মনের কথা বল।’
এভাবে আসলে হয়না। ফেবুতে ডিপ্রেশন কাটিয়ে দেয়া যায় না। এর জন্য পারিবারিক সহযোগিতা লাগে। ভাল বন্ধুবান্ধব লাগে। সুস্থ সমাজকাঠামো লাগে। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে রাষ্ট্রের ভাল উদ্যোগ লাগে। তাই এভাবে কাউকে সাহায্য করা যায় না। তবে কেউ যদি সত্যিই সাহায্য করতে চান, সেক্ষেত্রে একটি ডেডিকেটেড সময় রাখতে পারেন এমন মানুষদের জন্য, যাদের আপনি কাউন্সিলিং দেবেন। হুটহাট ৫/১০ মিনিট কথা বলে এসব হয় না। টানা লেগে থাকা লাগে।
তাই বলি কি, এইসব তো এত সোজা না। আর আপনিও পেশাদার কেউ না যে গণহারে সময় দেবেন! তার চেয়ে ভাল কি জানেন? ভাল হল প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ।
মেয়েটাকে জাজ করে করে, সমালোচনা করে করে, বাঁকা চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে, তার নামে সত্য মিথ্যা বানিয়ে বলে বলে, তাকে নিয়ে নানা ইঙ্গিত করে করে বেঁচে থাকতেই তার জীবন অতিষ্ট করে দিয়েছিলেন না? তাকে একা বন্ধুহীন আর বিষন্নতার রোগী বানিয়েছিলেন না?
বরং সেটা আর কারো সাথে করবেন না। এটাই আসল কাজ। বন্ধু হতে না পারেন, শুধু শুধু কারো শত্রু হবেন না। যাকে তাকে নিয়ে আজেবাজে কথা বলবেন না। মানুষকে দূর থেকে দেখে হাজারটা গল্প বানাবেন না। এগুলো মানুষের ক্ষতি করে। দুঃখের কারণ হয়। কষ্ট দেয়।
অল্প বয়সে এইসব মানতে কষ্ট হয় বলেই মানুষ বিষাদে ভোগে। আত্মহত্যা করে। বন্ধুহীন জীবন মানতে পারে না। সহ্য ক্ষমতা তো সবার এক হয় না!
এই বুড়ি বয়সে আমিই কত মিথ্যাচার দেখি, কত গল্প বানাতে দেখি আমাকে নিয়ে। দেখে এখনও কষ্ট হয়। আমাকে বিন্দুমাত্র না জেনে কত কুৎসিত কথা বলে কত লোকে। এত শক্ত আমি, তবু মন ভারি হয়। তবু দিনশেষে উঠে দাঁড়াই। এখন আমার কাউকে লাগে না। কিন্তু একুশ বছরের একটা মেয়ের এত সব সহ্য করার শক্তি নাও থাকতে পারে।
তাই মানুষের সম্পর্কে নোংরামি করবেন না। মানুষ নিয়ে নোংরা সমালোচনা করে করে তাকে হত্যা করবেন না। মরে যাওয়ার পর তখন ভাল ভাল কথা বলে আর লাভ নাই। আবার আপনার খারাপ খারাপ কথাতেও তখন তার কিছুই যায় আসবে না। তাই মানুষ বেঁচে থাকতেই ভালবাসতে চেষ্টা করুন। যদি না পারেন, অন্তত ঘৃণা করবেন না। কারো কোন কাজ বা কথা ভালো না লাগা মানেই তার বিরুদ্ধে ঘৃণা, সমালোচনা আর মিথ্যাচারের ফোয়ারা ছুটানো আর আজে বাজে প্রচারণা চালানো কোন সুস্থ সুন্দর মানুষের কাজ হতে পারে না।