সবচেয়ে বাজে ব্যাপার হলো, এসব অভিজ্ঞতা শেয়ার করলে আবার একদল মেয়ে বলে ওঠে, 'এগুলো কি শুধু তোমার সাথেই হয়? কই আমার সাথে তো হয়না, বানিয়ে বলো নাকি তাও বুঝি না!'

হাসনাহেনা বৃষ্টি: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই মেয়েটা ধর্ষিত হবার পরে একটা সাক্ষাৎকারে বলেছিলো, 'সে(ধর্ষক) আমাকে বারবার প্রশ্ন করছিলো আমি কি করি, কোথায় গিয়েছিলাম, কিন্তু আমি তাকে বলিনি যে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি কারণ আমার মনে হয়েছে এটা বললে সে আমাকে মেরেই ফেলবে, বাঁচতে দেবেনা।' 

এই সাক্ষাৎকার শুনে আমার মনে হচ্ছিলো, কেন? মেয়েটার কেন এমন মনে হল? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে এটা বললে কেন তার বাঁচার সম্ভাবনা কম? এই প্রশ্নের উত্তর আমি আজ পেয়েছি। 

সাধারণত যখন আমি রাস্তায় রিকশায়, বাইকে কিংবা গাড়িতে চলাচল করি, একজন যাত্রী হিসেবে পেছনের সিটে বসে, আমাকে সবসময়ই প্রতিদিনই কোনো না কোনোভাবে ইভটিজিং এর স্বীকার হতে হয়, যেটাকে কিনা আমি আমার দৈনন্দিন জীবনের অংশ হিসেবে মেনে নিতে শিখে গেছি একটা পর্যায়ে এসে। এরপর একটা সময়ে আমি যখন রাস্তায় সাইকেল নিয়ে বের হতে শুরু করলাম, তখন আমি খেয়াল করলাম তুলনামূলকভাবে এই সময়ে ইভটিজিং এর পরিমাণ বেড়ে গেলো। শুধু বেড়ে গেলো বললে ভুল হবে, অতিরিক্ত মাত্রায় বেড়ে গেলো। আমি অবাক হলাম এবং একটা সময়ে তাতেও অভ্যস্ত হয়ে গেলাম।

মিঃ হাইজিন: জীবাণুমুক্ত হাতের প্রতিশ্রুতি

কিন্তু ইদানীং যখন আমি রাস্তায় গাড়ি চালাই, আমি খেয়াল করি ইভটিজিং এর পরিমাণ লক্ষণীয় হারে আরও বেশি বেড়ে গেছে (অবশ্যই জানালার কাঁচ খোলা থাকলে, কারণ এসময় ছাড়া বাকি সময়ে তো আমার বোঝার উপায় নেই)। কিন্তু এই বিষয়টার জন্যে আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। আমার মনে হত গাড়ি চালানোর সময় তো আর আমাকে কেউ খোলামেলা ভাবে দেখতে পাবেনা, নিশ্চয়ই সাইকেল নিয়ে বের হওয়ার সময়ের মত ইভটিজিং এর স্বীকার হতে হবেনা। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে ঘটনা ঘটলো উল্টো। 
তাহলে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এনালাইসিস করে আমি যা বুঝলাম তা হল, আমাদের সমাজের একটা অংশ নারীর ক্ষমতায়ন ব্যাপারটা নিতে পারেনা। যতক্ষণ আপনি পেছনের সিটে বসে আছেন ততক্ষণ তারা আপনাকে স্বভাবসুলভ অশ্রদ্ধা করে, কিন্তু যখন তারা দেখে আপনি আর পেছনের সিটে বসে নেই অর্থাৎ আপনি নির্ভরশীল না তখন তারা আপনার প্রতি হিংস্র হয়ে যায়। এটা তাদের নিজেদের এক ধরনের ব্যক্তিগত ক্রাইসিসও বটে।

এর অর্থ কি দাঁড়ালো? এখানে জামাকাপড়, বয়স কিছুই কোনো ফ্যাক্ট না। যতক্ষণ তারা অনুভব করে আপনি তাদের নিয়ন্ত্রণে আছেন, ততক্ষণ তারা স্বাভাবিক মাত্রায় অসভ্যতা করে। আর যখন তারা অনুভব করে যে আপনি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে তখন তারা হিংস্রতার সাথে অসভ্যতা করে।

যখন আমি সাইকেল নিয়ে বের হই, অনেকে ইচ্ছা করে এসে মেরে দেয়। কোনো কারন নেই, কোনো সম্ভাবনা নেই এক্সিডেন্ট হওয়ার, অথচ ইচ্ছে করে গায়ের উপর উঠিয়ে দিয়ে তারা দাঁত বের করে একটা বিশ্রী হাসি দিয়ে, বিদঘুটে অঙ্গভঙ্গি করে বা একটা কটু কথা বলে চলে যায়। এই কাজটা খুব বেশি করে রিকশাওয়ালারা এবং বাইকাররা। অনেক সময়ে আবার এমন হয়, হেঁটে যাচ্ছে একটা লোক, সে ইচ্ছে করে সাইকেলের সামনে এসে আমাকে ব্রেক করতে বাধ্য করে একটু বিশ্রী করে তাকিয়ে চলে যায়। এগুলো ভিডিও করে দেখানো ছাড়া আসলে বোঝানো সম্ভব না।

উবার চালক শাহনাজ

কিন্তু এই কাজগুলো এরা কেন করে? একটা ছেলের সাথে তো করেনা। এই কাজটা এরা করে কারণ এরা বোঝাতে চায়, এটা রাস্তা, এটা আমাদের জায়গা, তুমি মেয়ে মানুষ, তুমি এখানে নামছো কেন? আমার মনে হয় এগুলো তাদের নিজেদের আইডেন্টিটি ক্রাইসিসেরও একটা বহিঃপ্রকাশ। সবথেকে বাজে ব্যাপার হল, এসব অভিজ্ঞতা শেয়ার করলে আবার একদল মেয়ে বলে ওঠে, 'এগুলো কি শুধু তোমার সাথেই হয়? কই আমার সাথে তো হয়না, বানিয়ে বলো নাকি তাও বুঝিনা!' এই কথাটা যে আমি বললাম এটা কোনো ধরনের এসাম্পশান না আমার। হুবুহু এই কথা শোনার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আমার আছে। ব্যাপারটা ভয়ানক না?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ধর্ষিতা মেয়েটার মৃত্যু ভয়ের কারন আমি আজ বুঝতে পেরেছি। মেয়েটা অনেক আগেই বুঝেছিলো বলেই হয়ত ওই যাত্রায় প্রাণে বেঁচে গেছে। আসলে মেয়ে হয়ে এই সমাজে জন্ম নিলে অনেক অপ্রীতিকর ব্যাপারই বুঝে, মেনে নেওয়া শিখতে হয়। এই সমাজের সবথেকে অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে এখানে একটা মেয়ে কোনো বিপদে পড়লে অন্য একটা মেয়েও পাশে এগিয়ে আসেনা, উপরন্তু দুটো কটু কথা শোনাতেও ছাড়েনা। This society makes me regret for being born here, every single moment of my life!


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা