গত দশ দিনে আমি ৫ জন নারীর সাথে কথা বলেছি, যারা সাংঘাতিক বাজে অবস্থায় আছেন। এদের মধ্যে দুইজন ঘর ছেড়েছেন। বা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। লকডাউনে পুরুষের হাত চলছে খুব। পুরুষ কেন নারীকে মারে? স্ত্রী বা প্রেমিকাকে মারে?

মাঝে মাঝেই আমি এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজি। এটা কি পুরুষের বেড়ে ওঠার দোষ? যে পুরুষ স্ত্রী বা প্রেমিকার গায়ে হাত তোলে সেই একই পুরুষ কিন্তু অফিসে সহকর্মীর গায়ে হাত তোলে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মায়ের গায়ে বা বোনের গায়েও হাত তোলে না। কিন্তু স্ত্রী বা প্রেমিকার গায়ে তোলে। কেন? নারীই বা কেন পুরুষের হাতে মার খায়? এই মার খাবার অভ্যাস কিংবা মেনে নেয়া, এটাও কি নারীর সামাজিক বেড়ে ওঠার মধ্যেই রক্তে ঢুকে যায়? পুরুষ যখন আঘাত করে, নারী কেন পড়ে পড়ে সেই আঘাত মাথা পেতে নেয়?

জন্মের পর থেকেই পুরুষকে 'পেশির তাকৎ' বলে একটা অশ্লীল জিনিস শেখানো হয়। গায়ের জোর। শারীরিক শক্তি দিয়ে অন্যের উপর প্রভাব বিস্তার। সেই শিক্ষাটা তাকে পরিবারই দেয়। এরপর সে স্কুল কলেজে যায়। সেই গায়ের জোর আর পেশির তাকৎ দেখাতে দেখাতে বড় হয়। যে পুরুষ তাকৎ দেখাতে পারে না, সেই পুরুষকে বলা হয় মেনীমুখো, মেয়েলী। ফলে পুরুষ পুরুষালী হয়ে উঠতে চায়।

আর দুর্ভাগ্যজনক হলো, এ সমাজে পুরুষালী শব্দের প্রতিশব্দ হয়েছে তাকৎবান, শক্তিমান, গায়ে গতরে বলশালী হওয়া ইত্যাদি। অথচ পুরুষালী মানে সেটি নয়। নারী ও পুরুষ দুটি ভিন্ন লিঙ্গ। এই দুটি লিঙ্গের কিছু শারীরিক পার্থক্য আছে। এই পার্থক্যগুলো যার যেমন, তেমন। পুরুষের শারীরিক বৈশিষ্ট্যকে পুরুষালী আর নারীর বৈশিষ্ট্যগুলো মেয়েলী। এখানে পুরুষালী মানেই শক্তিশালী আর মেয়েলী মানে দুর্বল, ল্যাতপ্যাতে- এই প্রতিশব্দ তৈরি করেছে এই সমাজ, বিজ্ঞান নয়।

জন্মের পর থেকেই পুরুষকে 'পেশির তাকৎ' বলে একটা অশ্লীল জিনিস শেখানো হয়

পুরুষ সমাজের তৈরি এইসব শব্দ সানন্দে গ্রহণ করেছে। নারীও করেছে। সমাজনীতি আর ধর্ম তাকে প্রেরণা যুগিয়েছে। নারী পুরুষের শাসনের বস্তু। মানে যে নারীকে সে অধিকার করবে, যাকে বিয়ে করবে, সে তার অধীন। এই অধীনস্ত নারীকে সে ইচ্ছেমত শাসন ও নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। যখন সেটি করা কঠিন বা অসম্ভব হয়ে ওঠে, তখন সে তার গায়ের জোর প্রদর্শণ করে। মারে। অত্যাচার করে। স্ত্রীর দিকে তেড়ে যাওয়া তাই অধিকাংশ পুরুষের বেড়ে ওঠার ভেতরে গেঁড়ে বসে আছে। এই তেড়ে যাওয়া দিয়ে শুরু। এরপর কিল লাথি চড় ঘুষি পর্যায়ক্রমে আসতে থাকে।

নারীর বেড়ে ওঠায় আছে মেনে নেওয়া ও নিয়ন্ত্রিত হবার অভ্যাস। তাকে অভ্যস্ত করানো হয়েছে। মানতে হবে। না মানলে শাসন করবে, সেই শাসনের সামনে কেঁচোর মত নেতিয়ে যেতে হবে। তাই স্বামী বা প্রেমিকের কিল চড় ঘুষি এগিয়ে এলে নারী ন্যাতায়ে যায়। নারীর ভেতরের অবচেতন অভ্যাস তাকে বলে এই শাসন মাথা পেতে নিতে। ফলে নারী মার খায়।

যে পুরুষ মাকে বা বোনকে নারী হওয়া সত্ত্বেও মারে না, সেই পুুরুষও স্ত্রীকে মারতে পারে। কারণ সে স্ত্রীকে মনে করে তার সম্পত্তি। মা বা বোন তা নয়। আবার অনেক পুরুষ মা বা বোনকেও মারে। যেকোন নারীকেই সে শাসন করতে চায়। এসব পুরুষের সংখ্যাও অনেক। সে বেড়ে ওঠার মধ্য দিয়ে এটাই শিখেছে যে, নারীকে শাসন করবার পূর্ণ অধিকার তার আছে। সেই শাসন যখন নারী মানবে না, তখন তাকে মারা যাবে। এই অভ্যস্ততা থেকে সহজেই তার হাত ওঠে, পা ওঠে। আর নারীর অভ্যস্ততা তাকে সেই হাত পায়ের নিচে নিজেকে সঁপে দিতে তৈরি করে রাখে।

যেসকল পরিবারের বাচ্চারা মায়েদের মার খাওয়া দেখে বড় হয়, তারাও সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে না

পুরুষের খবরদারি ঘরে বাইরে সবখানে। ঘরে সে নারীকে পিটায়। রাস্তায় ওড়না ছাড়া কোন মেয়ে দেখলে পিটাতে পারে না, কিন্তু তার হাত নিশপিশ করে। তখন সে টিজ করে, উপদেশ বা হুমকি দেয়। অফিসে নারী সহকর্মীকে তার মনমতো চলতে না দেখলে নানা তর্ক করে। তখনও তার হাত নিশপিশ করে মেয়েটাকে মারার জন্য। অনলাইনে মেয়েদের সপ্রতিভতা বা প্রতিবাদী পোস্ট দেখলে তার ক্রোধ জেগে ওঠে। সে তখন তাকেও উপদেশ, হুমকি বা গালাগালি দেয়। তবে তাদের মারতে পারেনা পরিস্থিতি আর আইনের ভয়ে। ঘরে তার সেই বাধা নেই। ফলে ঘরে এসে সে বউ পিটায়। এই বউ পিটানোর অধিকার সে জন্মমাত্র পেয়ে এসেছে, তার রক্তে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে এবং সমাজ অনুমোদন দিয়েছে।

লক ডাউনে যে পুরুষেরা বউ পিটাচ্ছেন, বউকে মানসিকভাবে হেনস্তা করছেন, তারা মনে রাখবেন, বউ পিটানোর দিন চিরকাল একরকম থাকবে না। যেকোন সময় আপনি ধরা খাবেন। আইনকে তুচ্ছ মনে করেন, সে ঠিক আছে। কিন্তু আইন একেবারেই আপনার মা-বাপ-চৌদ্দ গুষ্টির হাতে বানানো মোয়া, ব্যাপারটা তাও নয়।যেকোন সময় তাই হাতে হাতকড়া পরবে।

আর মেয়েরা যারা দিনের পর দিন পতিদেবের হাতের মার খাচ্ছেন, জুতা খাচ্ছেন আর ফিচফিচিয়ে কেঁদে অপেক্ষা করছেন, ‘উনি একদিন শুধরে যাবেন’ ভেবে, তাদের বলি, শরীরে এক ফোঁটা মানুষের রক্ত অবশিষ্ট থাকলে পড়ে পড়ে মার খাবেন না। যেকোনভাবে হোক বেরিয়ে আসুন। অত্যাচারীকে আইনের হাতে তুলে দিন। সে আপনার কয় বাচ্চার বাপ সে কথা ভেবে নিজেকে আর অসম্মানিত করবেন না। যে বাচ্চাদের কথা ভেবে আজ লাথি চড় ঘুষি পিঠ পেতে নিচ্ছেন, সেই বাচ্চারাও কোন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ হয়ে বড় হবে না। এমনও হতে পারে, বাচ্চার হাতেও এক সময় আপনি মার খাবেন।

তাই মানুষ হন। মাথা তুলে দাঁড়ান। আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচতে শিখুন। নিজেকে আর ছোট করবেন না।

আরও পড়ুন-


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা