সৌদি আরবে যদি একটি মেয়েও নির্যাতিত হয়ে কাঁদে, সেই কান্না কি পুরো বাংলাদেশের নয়?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
এই কান্নার শেষ কোথায়? একবার ভাবেন। শুধু লাশ হয়ে সৌদি আরব থেকে ফিরেছে ১৫৩ জন। সেই তালিকায় সর্বশেষ নাম কুলসুম। আচ্ছা বলেন তো আর কতো কুলসুম মরলে আমাদের টনক নড়বে?
ছোটখাটো নানা বিষয় নিয়ে আমরা মেতে থাকি কিন্তু কুলসুমদের মৃত্যু এলেই আমরা বেশিরভাগ মানুষ চুপ। এই যে দেখেন কুলুসুম নামে একটা মেয়ে যার বয়স ১৪, পাসপোর্টে ২৫ বানিয়ে তাকে পাঠানো হয়েছে সোদি আরবে।দেড় বছর পরই লাশ হয়ে পরিবারের কাছে ফিরেছে মেয়েটি।
গত ৯ আগস্ট সৌদি আরবের কিং ফয়সাল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মেয়েটা মারা গেছে। কীভাবে মরেছে শুনবেন? কুলসুম যে বাড়িতে কাজ করতো সেই বাড়ির নিয়োগকর্তা ও তার ছেলে মেরে দুই হাত-পা ও কোমর ভেঙে দিয়েছে। এরপর একটি চোখ নষ্ট করে দিয়েছে। তারপর ওই অবস্থায় রাস্তায় ফেলে গেছে। সৌদি পুলিশ সেখান থেকে কুলসুমকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানেই আস্তে আস্তে মরে যায় কুলসুম।
না কুলসুম একা নয়, ২০১৬ থেকে ২০১৯ র্পযন্ত চার বছরে বিভিন্ন দেশ কাজ করতে যাওয়া ৪১০ নারী লাশ হয়ে দেশে ফিরেছেন। এর মধ্যে শুধু সৌদি আরবেই প্রাণ হারিয়েছেন ১৫৩ জন। অথচ একটা ঘটনাতেও একজন সৌদি নাগরিককে আমরা শাস্তির আওতায় আনতে পারিনি।
সৌদি ছাড়া, র্জডানে ৬৪ জন, লেবাননে ৫২ জন, ওমানে ৩৮ জন, দুবাইয়ে ২৩ জন এবং কুয়েতে ২০ জন মারা গেছেন। অন্যান্য দেশ থেকে এসেছে ৬০ নারীর মরদেহ। এই ৪১০ জনের মধ্যে ৬৭ জন আত্মহত্যা করেছেন। শুধু সৌদি আরবেই আত্মহত্যা করেছেন ৩৯ জন। আত্মহত্যা ছাড়াও গত চার বছরে ৬৯ নারী দুর্ঘটনায় মারা গেছেন বলে নথিতে বলে হয়েছে। যার মধ্যে সৌদি আরবেই মারা গেছেন ২৯ জন।
পরিবারগুলো বলছে, প্রতিটি মৃত্যুতেই কোনো না কোনো কিন্তু আছে। এই যেমন ধরেন বেগমের ঘটনা। ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে সৌদি আরবে গিয়েছিলেন বেগম। সৌদি থেকে কীভাবে মিশরে গিয়ে তিনি মারা গেলেন সেই রহস্যের সমাধান হয়নি!
মিশরের বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে জানানো হয়, ২৯ মে মিশরে ৫ তলা থেকে পড়ে মোসাম্মৎ বেগম নামে এক নারী গৃহকর্মী মৃত্যুবরণ করেন। বেগমের স্বামী আব্দুল আজিজ বলেন, বেশ কিছু দিন আগে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের মাধ্যমে জানতে পারেন, বেগম নামে এক নারী মিশরে মারা গেছেন। কিন্তু তার স্ত্রী সৌদি আরবে থাকায় তিনি বিষয়টিতে গুরুত্ব দেননি। এরপর মিশর থেকে যখন তাকে ফোন করা হলো, তখন বুঝতে পারেন তার স্ত্রী মিশরে মারা গেছেন।
এ তো গেল মরে যাওয়াদের গল্প। মরে গিয়ে তাও তো তারা বেঁচেছে। আর যারা বেঁচে ফিরেছে? কুড়িগ্রামের এক নারী সংসারে সচ্ছলতার আশায় গিয়ে গৃহকর্তার ধর্ষণের শিকার হন। তিনি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন। পরে জীবন বাঁচাতে পালিয়ে আশ্রয় নেন রিয়াদের বাংলাদেশ দূতাবাসে। দুই মাস পর তিনি দেশে ফিরে আসেন।
দেশে এসে ঢাকার উত্তর বাড্ডার আরেক নারী বলেন, যে বাসায় তিনি কাজ করতেন, ওই বাসার পুরুষেরা তাকে শারীরিক নির্যাতন ও যৌন হয়রানি করতো। প্রতিবাদ করলে তার চুল টেনে টেনে তুলে ফেলা হতো। মানিকগঞ্জের এক নারী বলেছেন, সৌদি আরবের বনি ইয়াসার এলাকায় কাজ করতেন তিনি। নির্যাতনের কারণে চার তলা বাড়ির ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়েন। পরে তার স্থান হয় হাসপাতালের আইসিইউতে। কুমিল্লার এক নারীকে নির্যাতন করে মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়, ১৪টি সেলাই লাগে।
গত বছর এভাবে আড়াই হাজার মেয়ে দেশে ফিরেছে। ২০১৮ সালে ফিরেছে এক হাজার ৬৫৬ জন। কোনো কোনো সময় কর্তা ব্যক্তিরা বলেন, এই যে তিন লাখ নারী সৌদি আরবে গেল তার মধ্যে মাত্র তো আট-নয় হাজার ফিরেছে। বাকিরা নিশ্চয়ই ভালো আছে। ভালো আছে কি না সেটা আসলে জানা যায় না। কারণ সৌদি আরবের সেই বাড়িগুলোতে যাওয়ার অধিকার কারও নেই। আর এই যে শতাধিক নারী মারা গেল, কেন একটি ঘটনাতেও সৌদি নিপীড়নকারীদের শাস্তির আওতায় আনা গেল না!
যারা নির্যাতিত হয়ে ফিরছেন তাদের কী হবে? যারা মারা গেলেন? মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তো সংখ্যা দিয়ে বিচার করা যায় না। সৌদি আরবে যদি একটি মেয়েও নির্যাতিত হয়ে কাঁদে, সেই কান্না কি পুরো বাংলাদেশের নয়? এই কান্নার শেষ কোথায়? একবার ভাবেন। শুধু লাশ হয়ে সৌদি আরব থেকে ফিরেছে ১৫৩ জন। সেই তালিকায় সর্বশেষ নাম কুলসুম। আচ্ছা বলেন তো আর কতো কুলসুম মরলে আমাদের টনক নড়বে?
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন