এখনকার বাংলাদেশি চলচ্চিত্র নির্মাতাদের কাউকেই দেখছি না মানসম্পন্ন কোনো নির্মাণ দিয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরার চেষ্টা করতে। ‘জয় বাংলা’ যে শুধুমাত্র কোনো শব্দ যুগল নয়, বরং এর সাথে মিশে রয়েছে প্রায় সাড়ে তিন মিলিয়ন প্রাণ এবং সম্ভ্রম হারানোর ইতিহাস, আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস, এটা কী কেউ দয়া করে তুলে ধরবেন? নাকি, খেলার মতো সিনেমার সাথে রাজনীতি মেশাতেও আপনারা লজ্জা পান?
স্টিভ ট্রেভর। একজন ইন্টিলিজেন্স অফিসার। ডিসি কমিক বুকে একজন আমেরিকান সেনা হিসেবে বিবরণ দেয়া থাকলেও, ওয়ান্ডার ওম্যান সিনেমায় তাকে পোট্রে করা হয়েছে একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক হিসেবে যে কিনা ব্রিটিশ অ্যালাইড স্পাই হিসেবে শত্রু বাহিনীতে কর্মরত থাকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মিত এ সিনেমায় দেখানো হয়েছে, কিভাবে ছদ্মবেশে স্টিভ শত্রু বাহিনীর সিক্রেট মিলিটারি ক্যাম্প থেকে ইন্টেল চুরি করে তাদেরই বিমান নিয়ে পালায়। পলায়নের এক পর্যায়ে, শত্রু তাড়া খেয়ে অ্যামাজনিয়ান দ্বীপ থেমিসকারার তীরে বিমানসহ আছড়ে পড়ে। সেখান থেকে অ্যামাজন প্রিন্সেস ওয়ান্ডার ওম্যান তাকে উদ্ধার করে। সেল্যুলয়েডের এ কল্পকাহিনী থামিয়ে ফিরতে বাধ্য হচ্ছি বাস্তবতায়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার ঠিক ৪৩ বছর পরের ঘটনা। মাঝে হয়ে গিয়েছে আরেকটি ভয়াবহ বিশ্বযুদ্ধ। তখন ১৯৬১ সাল। পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে যোগ দেন এক যুবক। ১৯৬৩ সালে রিসালপুর পি.এ.এফ কলেজ থেকে পাইলট অফিসার হিসেবে কমিশন লাভ করেন। কমিশন প্রাপ্ত হবার পর তিনি করাচির মৌরিপুর (বর্তমান মাসরুর) এয়ার বেজ এর ২ নম্বর স্কোয়ার্ডন এ জেনারেল ডিউটি পাইলট হিসাবে নিযুক্ত হন। এখানে তিনি টি-৩৩ জেট বিমানের উপর কনভার্সন কোর্স সম্পন্ন করেন এবং ৭৫% নম্বর পেয়ে উর্ত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি এফ-৮৬ স্যাবর জেট এর উপরেও কনভার্সন কোর্স করেন এবং ৮১% নম্বর পেয়ে উর্ত্তীর্ণ হন। বৈমানিক কনভার্সন কোর্স এ ভালো ফলাফলের ভিত্তিতে তাকে পেশোয়ারে (১৯ নং স্কোয়ার্ডন) এ পোস্টিং দেয়া হয়। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় ফ্লাইং অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এরপর মিগ কনভার্সন কোর্সের জন্য পুনরায় সারগোদায় যান। সেখানে ১৯৬৭ সালের ২১ জুলাই তারিখে একটি মিগ-১৯ বিমান চালানোর সময় আকাশে সেটা হঠাৎ বিকল হয়ে গেলে দক্ষতার সাথে প্যারাসুট যোগে মাটিতে অবতরণ করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ইরানের রানী ফারাহ দিবার সম্মানে পেশোয়ারে অনুষ্ঠিত বিমান মহড়ায় তিনি ছিলেন একমাত্র বাঙালি পাইলট। রিসালপুরে দু'বছর ফ্লাইং ইন্সট্রাক্টর হিসাবে কাজ করার পর ১৯৭০ এ বদলি হয়ে আসেন জেট ফ্লাইং ইন্সট্রাক্টর হয়ে।
১৯৭১ সালের শুরুতে জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে সপরিবারে ঢাকায় দুই মাসের ছুটিতে আসেন। ২৫ মার্চের কালরাতে তিনি ছিলেন রায়পুরের রামনগর গ্রামে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে, পাকিস্তান বিমান বাহিনীর একজন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট হয়েও অসীম ঝুঁকি ও সাহসিকতার সাথে ভৈরবে একটি ট্রেনিং ক্যাম্প খুললেন। যুদ্ধ করতে আসা বাঙালি যুবকদের প্রশিক্ষণ দিতে থাকলেন। তিনি দৌলতকান্দিতে জনসভা করেন এবং বিরাট মিছিল নিয়ে ভৈরব বাজারে যান। মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করা অস্ত্র দিয়ে গড়ে তোলেন প্রতিরোধ বাহিনী। পাক-সৈন্যরা ভৈরব আক্রমণ করলে বেঙ্গল রেজিমেন্টে ই.পি.আর-এর সঙ্গে থেকে প্রতিরোধ বুহ্য তৈরি করেন। ১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল পাকিস্তানি বিমান বাহিনী এফ-৮৬ স্যাবর জেট থেকে তাদের ঘাঁটির উপর বোমাবর্ষণ করে। তিনি পূর্বেই এটি আশঙ্কা করেছিলেন। তাই ঘাঁটি পরিবর্তন করেন এবং ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পান তিনি ও তাঁর বাহিনী।
এরপর ১৯৭১ সালের ২৩ এপ্রিল ঢাকা আসেন এবং ৯ মে সপরিবারে করাচি ফিরে যান ৷ কর্মস্থলে ফিরে গিয়ে জঙ্গি বিমান দখল এবং সেটা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তাকে তখন বিমানের সেফটি অফিসারের দ্বায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো। তিনি বিমান দখলের জন্য ২১ বছর বয়সী রাশেদ মিনহা্জ নামে একজন শিক্ষানবীশ পাইলটের উড্ডয়নের দিন (২০ই আগস্ট, ১৯৭১) টার্গেট করেন। তাঁর পরিকল্পনা ছিলো মিনহাজ কন্ট্রোল টাওয়ারের অনুমতি পেয়ে গেলে তিনি তাঁর কাছ থেকে বিমানটির নিয়ন্ত্রন নেবেন। পরিকল্পনা অনুসারে অফিসে এসে শিডিউল টাইমে গাড়ি নিয়ে চলে যান রানওয়ের পূর্ব পাশে। সামনে দুই সিটের প্রশিক্ষণ বিমান টি-৩৩। পাইলট রাশেদ মিনহাজ বিমানটি নিয়ে দ্বিতীয় বারের মত একক উড্ডয়নের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কন্ট্রোল টাওয়ার ক্লিয়ারেন্সের পর মিনহাজ বিমানটি নিয়ে রানওয়েতে উড্ডয়নের প্রস্তুতি নিলে তিনি সেফটি অফিসারের ক্ষমতাবলে বিমানটি থামাতে বলেন। মিনহাজ বিমানটি থামান এবং ক্যানোপি (জঙ্গি বিমানের বৈমানিকদের বসার স্থানের উপরের স্বচ্ছ আবরন) খুলে বিমান থামানোর কারণ জানতে চান। এসময় তিনি বিমানের ককপিটে চড়ে বসেন এবং রাশেদ মিনহাজকে ক্লোরোফর্ম দিয়ে অচেতন করে ফেলেন। জ্ঞান হারানোর আগে রাশেদ মিনহাজ কন্ট্রোল রুমে জানাতে সক্ষম হন তিনিসহ বিমানটি হাইজ্যাক হয়েছে। বিমানটি ছোট পাহাড়ের আড়ালে থাকায় কেউ দেখতে না পেলেও কন্ট্রোল টাওয়ার মিনহাজের বার্তা শুনতে পায় এবং রাডারে বিমানের অবস্থান বুঝে অপর চারটি জঙ্গি বিমানসহ তাকে ধাওয়া করে। মৃত্যু আসন্ন জেনেও তিনি বিমানটি নির্ধারিত সীমার নিচে চালিয়ে রাডার কে ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশে অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আসার চেষ্টা করেন।
প্রায় ভারতের সীমান্তে পৌঁছে যাওয়া অবস্থায় রাশেদ মিনহাজ জ্ঞান ফিরে পান এবং বিমানটির নিয়ন্ত্রন নিতে চেষ্টা করেন। এ সময় রাশেদের সাথে তার ধ্বস্তাধস্তি চলতে থাকে এবং এক পর্যায়ে রাশেদ ইজেক্ট সুইচ চাপলে তিনি বিমান থেকে ছিটকে পড়েন। বিমানটি কম উচ্চতায় উড্ডয়ন করার ফলে একসময় রাশেদ সহ বিমানটি ভারতীয় সীমান্ত থেকে মাত্র ৩২ মাইল দূরে থাট্টা এলাকায় বিধ্বস্ত হয়। তাঁর সাথে প্যারাসুট না থাকাতে তিনি নিহত হন এবং মৃতদেহ ঘটনাস্থল হতে প্রায় আধ মাইল দূরে পাওয়া যায়। পাকিস্তান সরকার তাঁর মৃতদেহ করাচির মাসরুর বেসের চতুর্থ শ্রেণীর কবরস্থানে সমাহিত করে। তাঁর কবরের ফলকে কী লেখা ছিলো জানেন? "ইয়াহা সো রাহাহে এক গাদ্দার!" দীর্ঘ ৩৫টি বছর গাদ্দার পরিচয়েই তিনি সমাহিত ছিলেন। কল্পনা করা যায়? পরবর্তীতে, ২০০৬ সালের ২৪ জুন তাঁর দেহাবশেষ পাকিস্তান হতে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হয়। তাঁকে পূর্ণ মর্যাদায় ২৫শে জুন শহীদ বুদ্ধিজীবী গোরস্থানে পুনরায় দাফন করা হয়।
ছবিতে যে মানুষটিকে দেখছেন, বলছিলাম তাঁরই কথা। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান। আমাদের বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান। তাঁর নাম লেখার আগে এতো ইতিহাস তুলে ধরার কারণ, তখন তাঁর বয়স ছিলো মাত্র ২৯, স্ত্রী-সন্তান-পরিবার সবই ছিলো, ছিলো সামরিক মর্যাদা, তিনি চাইলেই সেখানে প্রথম শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকতে পারতেন। অথচ, মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য বেছে নিয়েছিলেন চতুর্থ শ্রেণীর কবরস্থান। তাঁকে উদ্ধার করার জন্য কোনো ওয়ান্ডার ওম্যান ছিলো না। তিনি হতে পারেননি কোনো কমিক বুকের আইকনিক ক্যারেক্টার। তাঁকে নিয়ে তৈরি হয়নি কোনো আন্তর্জাতিক মানের সিনেমা। অগ্নিবলাকা নামের একটি টেলিফিল্ম নির্মিত হয়েছিলো নামেমাত্র!
বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা নিয়ে প্রচুর আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। পুরস্কারের কথা না হয় বাদই দিলাম। সেগুলো যেমন ব্যবসাসফল হয়েছে, তেমনি কোটি মানুষের হৃদয় বসতি গড়েছে। অথচ আমাদেরও রয়েছে সীমাহীন ত্যাগ এবং গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। ডিসি কমিক্সের সুইসাইড স্কোয়াড আমাদের কাছে খুব কুল লাগে, কিন্তু বাংলার মুক্তির গান আমরা দেখি নাই, ক্র্যাক প্ল্যাটুনের ইতিহাস রয়ে যায় অজানাই। টম ক্রুজের মিশন ইম্পসিবলে আমরা চরম থ্রিল পাই, কিন্তু অপারেশন জ্যাকপটে আমাদের আগ্রহ নাই। এই ইতিহাসটুকু আন্তর্জাতিক পর্যায় পর্যন্ত পৌছে দেয়ার মতো নির্মাতাও নাই। যারাও ছিলেন, তাদেরকেও অকালেই বিদায় জানাতে হয়েছে, এতোটাই দুর্ভাগ্য আমাদের। পাশ্চাত্যের ইতিহাস দেখে আমরা যখন নয়ন জলে ভাসি, সেই জলেই হয়তো আমাদের নিজেদের ইতিহাস ডুবে মরে। সেই কবে থেকে অপেক্ষায় আছি নিজেদের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রের জয়জয়কার দেখবো আন্তর্জাতিক সিনেমা অঙ্গনে, যতোই যুদ্ধভিত্তিক সিনেমা দেখি- ততোই এ আফসোস বাড়তে থাকে।
অথচ এখনকার বাংলাদেশি নির্মাতাদের কাউকেই দেখছি না মানসম্পন্ন কোনো নির্মাণ দিয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরার চেষ্টা করতে। ‘জয় বাংলা’ যে শুধুমাত্র কোনো শব্দ যুগল নয়, বরং এর সাথে মিশে রয়েছে প্রায় সাড়ে তিন মিলিয়ন প্রাণ এবং সম্ভ্রম হারানোর ইতিহাস, আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস, এটা কী কেউ দয়া করে তুলে ধরবেন? নাকি, খেলার মতো সিনেমার সাথে রাজনীতি মেশাতেও আপনারা লজ্জা পান?