আমাদের শৈশব আর কৈশরের সোনালী স্মৃতির সঙ্গে ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল এবং তার বইগুলো জড়িয়ে আছে ঘনিষ্ঠভাবে। একেকটা বই ছিল আমাদের অবসরের সঙ্গী। পাঠ্যবইয়ের ভেতরে এই বইগুলো লুকিয়ে পড়তে গিয়ে কত মারও খেয়েছি!

ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের নামটাই আমাদের কাছে ছোটবেলায় ছিল সুপারম্যানের মতোই। তার লেখা গল্প আর কিশোর উপন্যাসগুলো ছিল আমাদের সার্বক্ষণিক সঙ্গী। বই পড়ার অভ্যাস গড়ে ওঠার পেছনে হুমায়ূন আহমেদের পরে যদি কারো অবদান থেকে থাকে, তাহলে সেটা অবশ্যই মুহম্মদ জাফর ইকবালের। সায়েন্স ফিকশন থেকে শুরু করে কিশোর উপন্যাস কিংবা ছোট-বড় গল্প, সবই গোগ্রাসে গিলেছি আমরা। কপোট্রনিক সুখ দুঃখ, আমি তপু, আমার বন্ধু রাশেদ, দীপু নাম্বার টু, রাজু ও আগুন আলীর ভূত, ক্যাম্প, বিজ্ঞানী সফদর আলী সিরিজ, টুকুনজিল, অনুরণ গোলক, ফোবিয়ানের যাত্রী, হাতকাটা রবিন- একেকটা বই ছিল আমাদের অবসরের সঙ্গী। পাঠ্যবইয়ের ভেতরে এই বইগুলো লুকিয়ে পড়তে গিয়ে কত মারও খেয়েছি!

আমাদের শৈশব আর কৈশরের সোনালী স্মৃতির সঙ্গে ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল এবং তার বইগুলো জড়িয়ে আছে ঘনিষ্ঠভাবে। মুহাম্মদ জাফর ইকবালের প্রায় সব বই-ই কমবেশি পড়া আছে পাঠকদের, বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের মধ্যে তার যে তুমুল জনপ্রিয়তা, তাতে করে তার কোনো বই মিস দেয়াটাই বরং অবাক করার মতো ব্যাপার। এরমধ্যে এমন কিছু বই আছে, যেগুলো না পড়াটা একরকম পাপের পর্যায়েই পড়ে! বইমেলার এই মাসে সেরকমই পাঁচটা বই নিয়ে আমাদের আজকের আয়োজন।

দীপু নাম্বার টু- ছোটবেলায় আমাদের পড়া সবচেয়ে প্রিয় উপন্যাস ছিল এটা। বাবার চাকরির সুবাদে পাহাড়ি এক শহরে আসা দীপুর সঙ্গে মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে গিয়েছিলাম আমরা, তারেক আর দীপুর খুনসুটি, তারপর ঝগড়া, আর শেষে বন্ধুত্ব- সবকিছুই তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেছিলাম সেসময়। মায়ের সঙ্গে দীপুর সম্পর্ক আমাদের ভাবিয়েছে, মূর্তি পাচারকারীদের ধরিয়ে দেয়ার অংশটা পড়ে অদ্ভুত এক আনন্দে মাতোয়ারা হয়েছে মন। কিংবা উপন্যাসের শেষ অংশে সবাইকে ছেড়ে দীপুর বিদায় নেয়ার সময়টায় অকারণেই যেন চোখের কোণে জল জমেছিল। এখনও, জীবনের এই বড়বেলায় এসেও এই উপন্যাসটা পড়তে গেলে আবেগতাড়িত হই, ঠিক আগের মতোই!

আমার বন্ধু রাশেদ- আমার বন্ধু রাশেদ লেখা হয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে। দেশকে স্বাধীন করার ডাকে এক কিশোরের মনও কীভাবে আন্দোলিত হয়েছে- সে চিত্রই ফুটে উঠেছে উপন্যাসের কাহিনীতে। প্রেক্ষাপট হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে মফস্বলের ছোট একটা শহর। আর চরিত্রগুলো হচ্ছে কয়েকজন স্কুলছাত্রের। একাত্তরের সেই অস্থির সময়টাতে একদিন ছোট্ট সেই শহরে হানা দেয় পাকিস্তানী হানাদার আর তাদের দোসর রাজাকারেরা। সম্মুখযুদ্ধে বন্দী হওয়া এক মুক্তিযোদ্ধাকে কৌশল খাটিয়ে মুক্ত করে নিয়ে আসে রাশেদ আর তার বন্ধুরা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সব বন্ধু যখন আবার একত্র হয় ছোট্ট শহরটিতে, তারা আবিষ্কার করে রাশেদ নামের অদ্ভুত ছেলেটি তাদের মাঝে আর নেই। রাশেদের সেই বিয়োগাত্নক পরিণতি আমাদের বোবাকান্নার কারণ হয়েছে অজস্রবার। উপন্যাসের ইবু কখনও রাশেদকে ভোলেনি, রাশেদকে ভুলতে পারিনি আমরাও। কোন এক মাঝরাত্তিরে ইবুর মতো আমরাও হয়তো আনমনে রাশেদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছিলাম, জানতে চেয়েছিলাম, রাশেদ ভালো আছে তো? রাশেদ তো কেবল ইবুর বন্ধুই ছিল না, আমারও যে বন্ধু ছিল রাশেদ!

পরবর্তীতে মোরশেদুল ইসলামের পরিচালনায় এই বইটি থেকে সিনেমা তৈরী হয়

টুকুনজিল- এরকম নাম কি কারো হতে পারে? হ্যাঁ, পারে, যদি প্রাণীটা হয় ভিনগ্রহবাসী কেউ! টুকুনজিলের সঙ্গে উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র বিলুর পরিচয়ের ধরণটাও খুব অদ্ভুত। গ্রাম থেকে হুট করেই শহরে চলে আসা বিলু যখন নতুন পরিবেশ আর নতুন মানুষদের মাঝে খাপ খাওয়ানোর যুদ্ধে ব্যস্ত ছিল, তখনই একদিন টুকুনজীল আসে তার জীবনে, বন্ধু হয়ে। ঝিঁঝিঁ পোকার মতো দেখতে টুকুনজিলকে হাতে পাবার জন্যে কত চক্রান্ত, কত ষড়যন্ত্র! বিলু কি পারবে, তার বন্ধু টুকুনজিলকে নিরাপদে নিজের গ্রহে ফিরে যেতে সাহায্য করতে? নাকি পরাজিত হবে মানবসমাজের কূটবুদ্ধির কাছে? রাতের আকাশে এন্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি খুঁজে বের করার কত চেষ্টা করেছি আমরা 'টুকুনজিল' পড়ার পরে, যদি সেই ছোট্ট প্রাণীটার গ্রহের কোন হদিশ পাওয়া যায়! শিশু-কিশোরদের জন্যে জাফর ইকবাল স্যারের এই সায়েন্স ফিকশনটা অবশ্যপাঠ্য।

স্কুলের নাম পথচারী- হঠাৎ করেই লটারীতে ৩০ লক্ষ টাকা পেয়ে গেলেন ফরাসত আলী। বন্ধু ফারুখ বখতকে নিয়ে প্ল্যান করতে বসে গেলেন কি করা যায় এত টাকা দিয়ে। এদিকে লটারির সেই টিকেটটি হাত করার জন্য কিছু মানুষের মধ্যে শুরু হয়ে যায় অসুস্থ প্রতিযোগিতা। এটা সেটা নানান চিন্তার পর ফরাসত আলী ও ফারুখ বখত মিলে ঠিক করলেন স্কুল দিবেন গরীব বাচ্চাদের জন্য। হারুন ইঞ্জিনিয়ার এসে হাজির এই খবর শুনে। নিজের আবিষ্কার করা প্লাস্টিজিন দিয়ে একটা স্কুল বানিয়ে ফেললেন তিনি। কিন্তু একি! স্কুলের মেঝে যে আকাশ থেকে ঝুলছে! স্কুল চালাতে গিয়ে তাদের হিমশিম খাবার মত অবস্থা। কত ধানে কত চাল, সেটা তারা বুঝতে শুরু করলেন তারপর থেকেই। একটার পর একটা বাধা, স্কুল ইন্সপেকশনের সেই অংশটা পড়ে হাসি থামানো যাচ্ছিল না কোনভাবেই। মহসীন, রুখসানা, রাণুদি, প্রফেসর আলী, নার্স মার্থা কিংবা পিয়ন চুন্নু মিয়া- সবগুলো চরিত্রই আমাদের ভীষণ আপন, অনেক কাছের।

শান্তা পরিবার- এতিম এক মেয়ে শান্তার নামে গল্পের নামকরণ। ছোটবেলা থেকেই অনাদর আর অবহেলায় বট হয়েছে। ভালোবেসে বিয়ে করেছিল বন্ধু শওকতকে। শান্তার ইচ্ছে ছিল, তার হাফ ডজম বাচ্চাকাচ্চা হবে, তাদেরকে সে নিজের সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে মানুষ করবে। কিন্ত ভাগ্যের পরিহাসে পঞ্চম সন্তানের জন্মের পরে এক রোড এক্সিডেন্টে মারা গেল শান্তা। পাঁচটে অবাধ্য আর দুষ্টু ছেলেমেয়ে নিয়ে মোটামুটি অকুল পাথারে পড়লো শওকত!  শান্তা চলে যাওয়ার পর সবাই হাড়ে হাড়ে টের পেল শান্তা আসলে কি ছিল পরিবারের জন্য। এক হাতে সে পুরোটা পরিবার সামলে রাখতো। শান্তা চলে যাওয়ার পর ৫ বাচ্চারা মিলে সংসার আগলিয়ে রাখতে শুরু করল। আর ঘটতে থাকল হাসি কান্নার মিশেলে মজার মজার সব ঘটনা। যা একই সাথে মনকে নাড়া দেয় কাদায়ও। এই সব গল্পই শান্তা পরিবারের। সাজানো গোছানো সেই সংসারটা কি শওকত আগলে রাখতে পারবে? নাকি উত্তাল কোন ঝড় এসে ভেঙে দেবে সেই সুখের নীড়? দুষ্টু ছেলে-মেয়েগুলোকে বশে রাখা যাবে কীভাবে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গেলে পড়তে হবে উপন্যাসটি। 'শান্তা পরিবার' এমনই একটা উপন্যাস, যেটি আপনাকে এখন হাসাবে, পরমূহুর্তেই মন খারাপ করিয়ে দেবে ভীষণভাবে!


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা