এখনো যখন স্যার আগের মতই সব সময় মুক্তিযুদ্ধের কথা বলেন, তখন সেটা এত নকল মুক্তিযুদ্ধের ভীড়ে আলাদা করা যায় না। এটাই সাধারণত দু:সময়ের যোদ্ধাদের জীবনের সব থেকে বড় ট্রাজেডি।

আমরা যেভাবে জাফর ইকবাল স্যারের একটা কলামের অপেক্ষায় বসে থাকতাম, এখন হয়তো কেউ সেভাবে অপেক্ষা করে না। আমি এখনো প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে স্যারের কলাম প্রকাশিত হল কিনা সেটা খোঁজ করি, আগ্রহ নিয়ে পড়ি এবং অন্যদের সুবিধার্থে শেয়ার করি। এখন ফেসবুকে ২৪ ঘন্টা সকল বিষয় নিয়ে, সকলেই বিশেষজ্ঞ মতামত দেয়, ব্যাখ্যা করে। এখন মোটামুটি সবাই কলামিস্ট। কাজেই অনেকের কাছে মনে হতে পারে ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল এখন আর প্রাসঙ্গিক নয়। 

আমি যখন জাফর ইকবাল স্যারের বই পড়া শুরু করি ততদিনে স্যার অনেক বই লিখে ফেলেছেন। কিশোর উপন্যাস, সাইন্স ফিকশন, কলাম, পিওর সাইন্সের বই ইত্যাদি সব বিষয়ের উপর তাঁর অনেক বই ততদিনে লেখা হয়ে গেছে। ফলে আমি একটানা অনেক গুলো ভালো ভালো বই পড়ে ফেলতে পেরেছি, যা আমার চিন্তার পথটা গড়ে দিয়েছিল। সব বই যখন পড়া হয়ে গেল, তখন অপেক্ষায় থাকতে হত পরের বছরের বই মেলার জন্য। এখনো একই ভাবে অপেক্ষায় থাকি, এ বছর তাঁর কী কী বই বের হচ্ছে সেটা নিয়ে। নতুন বই হাতে নেয়ার পর এক ধরণের উত্তেজনা কাজ করে। এখনকার ছেলেমেয়েদের মধ্যে কি এই উত্তেজনা আছে? তারা কি এখন স্যারের বই পড়ে? সম্ভবত পড়ে না। পড়লে অমুক হ্যাকস, তমুক মোটিভেশনাল বই বেস্ট সেলার হওয়ার কথা নয়! তাই অনেকের কাছে মনে হতেই পারে কিশোর সাহিত্য বা সাইন্স ফিকশনে ড.মুহম্মদ জাফর ইকবাল এখন আর প্রাসঙ্গিক নয়। 

২০১১/১২ সালের দিকে একবার কোন এক কলামে স্যার লিখেছিলেন, তিনি আর রাজনৈতিক কলাম লিখবেন না। সেটা পড়ে আমি খুব রেগেমেগে তাঁকে কড়া ভাষায় একটা চিঠি লিখে পাঠালাম। লিখেছিলাম, আমার চিন্তার জগতটা গড়ে উঠেছে আপনার লেখা পড়ে। আমি মুক্তিযুদ্ধ ও দেশ নিয়ে ভাবতে শিখেছি আপনার কলাম পড়েই। আমি জাতপাত-ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষকে বিচার করতে শিখেছি আপনার লেখা থেকেই। কেন আপনি লিখবেন না? আপনাকে অবশ্যই লিখে যেতে হবে। ৬ মাস পর আমাকে অবাক করে দিয়ে চিঠির উত্তর আসলো! সেই চিঠি এখনো পরম যত্নে আমি আমার সংগ্রহে রেখে দিয়েছি। 

কিন্তু এটা তো আমার ব্যক্তিগত আবেগের জায়গা। সামগ্রিক ভাবে তিনি বর্তমান প্রজন্মের কাছে এখনো প্রাসঙ্গিক কিনা? অনেকের কাছে মনে হতে পারে তিনি আর প্রাসঙ্গিক নন। তবে আমার কাছে, ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল এখনো অনেক বেশি করেই প্রাসঙ্গিক।

আমার কাছে যখন কেউ বাচ্চাদের জন্য বই পড়ার সাজেশন চায় আমি তখন বাচ্চার বয়স অনুযায়ী স্যারের লেখা কমিক্স, একটু বড় হলে কিশোর উপন্যাস, তারপর সাইন্স ফিকশন আর বিজ্ঞানের বই এবং একটু বড় হলে কলাম গুলো পড়তে পরামর্শ দেই। বাংলাদেশের বাবা মায়েদের পরম সৌভাগ্য, এদেশে জাফর ইকবাল নামের একজন মানুষ শিশু কিশোরদের জন্য লেখালেখি করেন। কোন মতে বাচ্চাকে তাঁর বইয়ের সাথে পরিচিত করিয়ে দিতে পারলে, বাচ্চার মানসিক বিকাশ নিয়ে তাদের আর কোন চিন্তা করতে হবে না! তাঁর লেখা সাইন্স ফিকশন হোক বা কিশোর উপন্যাস - শেষ পর্যন্ত মানুষের জয়, মানবতার জয় এবং শুভ'র জয় দেখায়। ভালোবাসার জন্য ত্যাগ করতে শেখায়। এগুলোর থেকে বড় মোটিভেশন তো আর কিছু হতে পারে না। কাজেই আমাদের সময় যেমন, বর্তমান এবং ভবিষ্যতেও তাঁর লেখা সমান প্রাসঙ্গিক, অবশ্যপাঠ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ। 

একটা সময় ছিল যখন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলা যেত না। 'পাকিস্তানি সেনারা আক্রমণ করেছিল'- এটা বলা হত না। বই পত্রে লেখা হত 'হানাদার' বা 'পাঞ্জাবি' এভাবে! তখন রাজাকাররা মন্ত্রী ছিল, গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা লাগিয়ে ঘুরতো। সে সময় এই মানুষটি বিশাল ঝুঁকি নিয়ে লাগাতার মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে গেছেন, রাজাকারদের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছেন। তাঁর বাড়িতে বোমা হামলা হয়েছিল, পাঠানো হয়েছিল কাফনের কাপড়। এখন তো সেই সময় নেই। এখন সুসময়! এখন সবাই মুক্তিযুদ্ধ শব্দটি ব্যবহার করে। এমনকি সন্ত্রাসীরাও তাদের সংগঠনের নাম হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ শব্দটি ব্যবহার করে! কাজেই এখনো যখন স্যার আগের মতই সব সময় মুক্তিযুদ্ধের কথা বলেন, তখন সেটা এত নকল মুক্তিযুদ্ধের ভীড়ে আলাদা করা যায় না। এটাই সাধারণত দু:সময়ের যোদ্ধাদের জীবনের সব থেকে বড় ট্রাজেডি। সর্বশেষ এক মৌলবাদীর আক্রমণে তিনি মৃত্যুর একেবারে কাছ থেকে ফিরে এসেছেন। কিন্তু এসময়ের ফেসবুকীয় জাজমেন্টাল চিন্তা ভাবনা তাঁকে রেহাই দেয়নি! 

ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল এদেশের একজন বিরল বুদ্ধিজীবী যিনি মোটামুটি সর্বমহলের থেকেই গালি খেয়ে থাকেন। কিন্তু আমাদের জেনারেশন, যারা অন্ধকার সময়ে পথের দিশা পেয়েছি তাঁর থেকে, তাঁর অবদান ভুলতে পারি না। আমরা জানি, আবারো যদি কখনো দু:সময় আসে, তখন এই লেখা গুলো আলোকবর্তিকা হয়ে পথ দেখাবে। আমি জানি, আমার সন্তান যদি কেবল আমার সংগ্রহে থাকা স্যারের বই গুলোই পড়ে, তাহলে তার মানসিকতার বিকাশ নিয়ে আমাকে আর ভাবতে হবে না। সে মানবিক হবে, দেশপ্রেমিক হবে, মুক্তিযুদ্ধ কে ভালোবাসবে, ঘৃণা করবে রাজাকার- যুদ্ধাপরাধীদের, চিন্তা করব যুক্তি দিয়ে, হবে বিজ্ঞান মনস্ক। তাই আমার কাছে, আমার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য তিনি এখনো সমান ভাবেই প্রাসঙ্গিক। তিনি ফুরিয়ে যাননি। তাঁর লেখা এখনো সেই উত্তেজনাই আমাদের মধ্যে সঞ্চালিত করে, যা করতো সেই চিন্তার অ আ ক খ শেখার সময়টাতে। 

জন্মদিনের শুভেচ্ছা ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। আপনাকে ধন্যবাদ...


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা