যে ১০টি কারণে জাফর ইকবাল স্যারকে ভালোবাসি!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। অজস্র অজস্র কারণ আছে তাঁকে ভালোবাসার। তার মাঝে স্রেফ দশটি কারণ আলাদা করে তুলে ধরা হয়েছে এখানে...
জাফর ইকবাল স্যার আমাদের চেতনার বাতিঘর
সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে লিখেছিলেন হুমায়ূন আজাদ। সময়ে সময়ে নষ্টদের অধিকারে আসলেই সবকিছু চলে যায়। আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে কাউকেই হয়তো শতভাগ শুদ্ধ দাবী করা যায় না। ব্যাতিক্রম একজন জাফর ইকবাল। তাঁর লেখা, হ্যাঁ একমাত্র তাঁর লেখাই এই দীর্ঘ সময় ধরে লাইনচ্যুত হয়নি। আজকের প্রজন্মের জন্য একজন জাফর ইকবাল হচ্ছেন চেতনার মূর্ত লাইট হাউজ।
আশাবাদের প্রতীক
বছর তিনেক আগে সাস্ট সাহিত্য পরিষদের আমন্ত্রণে আমি সিলেট যাই বিজয় দিবসের একটা প্রোগ্রামে। সেখানে আমার প্রায় দেড় ঘন্টার একটা সেশন ছিল এবং স্যার পুরোটাই দেখেছেন। আমার বক্তব্যে আমি জোর দেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সামান্যীকরণ নিয়ে। এই প্রজন্মের অনেকের ইতিহাস লঘূকরণের বর্ণনা কিংবা ইতিহাস নিয়ে হাসি/তামাশা করা নিয়ে কথা বলতে গেলে আমি একটু বেশিই উত্তেজিত হয়ে যাই এবং আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি।
প্রোগ্রামের শেষে স্যার মঞ্চে উঠে বলেন 'দেখ বাবা, সব ঠিক হয়ে যাবে, ওরা ঠিকই পড়বে, ওদেরকে একটু-আধটু ফেসবুক চালাতে দাও, এই প্রজন্মই কিন্তু শাহবাগ করে দেখিয়েছে...!' এই যে আশাবাদ, এই যে প্রেরণা এটা বোঝানোর জন্যই ঘটনাটা উল্লেখ করলাম। স্যারের প্রতিটা লেখা শেষ হয় আশাবাদ দিয়ে। যখন শাহবাগের ওপর আক্রমণ চলছিল একেরপর এক, যখন একটার পর একটা ব্লগার হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হচ্ছে, যখন গুম খুন হচ্ছে, যখন প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে, যখন শিক্ষা খাতে দুর্নীতি হচ্ছে সবসময়েই তিনি সামনের দিনে আশাবাদের কথা বলেছেন। দিয়েছেন সামনে এগিয়ে চলার প্রেরণা।
ন্যায্যতা
২০০৮ সালের বই মেলায় নজরুল মঞ্চের সামনে স্যারের অটোগ্রাফ শিকারিদের ভিড় বরাবরের মত। স্যারের ভক্তকূল লাইন ধরে সুশৃঙ্খল ভাবে অটোগ্রাফ নিচ্ছে। লাইন ভেঙে এসে এক মহিলা সামনে গিয়ে স্যারকে বলছেন- "স্যার, আমার ছেলে আপনার অন্যরকম ভক্ত। একটা অটোগ্রাফ দেন..."। স্যার ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন- "দেখি তুমি আমার কেমন ভক্ত, একেবারে লাইনের শেষে চলে যাও। লাইন ধরে এসে অটোগ্রাফ নিয়ে যাও, তাহলে বুঝবো আসলেই তুমি আমার ভক্ত!"
কাউকে ফেরান না
প্রায় দশ বছর আগের কথা। আমার বন্ধুর ছোট বোন স্যারকে চিঠি লিখবে। আমার কাছে ঠিকানা খুঁজছে। আমি মনে মনে ভাবি স্যারের উত্তর পাওয়া কি এত সহজ, তাও দিলাম ঠিকানা। একদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে আমিই পোস্ট করলাম। সাপ্তা-খানেক পর উত্তর আসলো। এভাবে কত-শত বাচ্চা-কাচ্চা যে জাফর ইকবালের কাছ থেকে একটা চিঠি পেয়ে ধন্য হয়েছে তার ইয়ত্তা নাই। মজার বিষয় হচ্ছে আমাদের পোস্ট করা চিঠিটাতে ডাকটিকেটে কোন একটা গণ্ডগোল হয়েছিলো, ফলে দ্বিগুণ মাশুল দিয়ে স্যারকে চিঠিটা সংগ্রহ করতে হয়।
শাহবাগ আন্দোলন
অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক সম্বন্ধে অনেকে বলেন তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের স্থপতিগণের মধ্যে পড়েন। কেউ কেউ বলেন আওয়ামী লীগ-প্রণীত ঐতিহাসিক ছয়দফার মূল ধারণা তাঁরই চিন্তার ফসল, এর সত্য মিথ্যা জানি না। তবে ২০১৩ সালের শাহবাগ আন্দোলনের পেছনে যেই বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গা সেটা মাঠ পর্যায়ে তৈরি করার পেছনে যদি কয়েকটা নাম আসে তাহলে সবার আগে স্যারের নাম আসবে। নব্বই পরবর্তী প্রজন্মের কাছে যুদ্ধাপরাধের বিচার, ঘাতক-দালালদের কর্মকাণ্ডের বয়ান, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এসবকিছু একেবারে ইঞ্জেক্ট করে দেয়ার পেছনে সবচাইতে বড় ভূমিকা যদি কারো থেকে থাকে তাহলে তিনি জাফর স্যার। আর সেই চিন্তা চর্চার ফসল হচ্ছে ২০১৩।
উৎসাহ
মাশরাফি সম্পর্কে সবাই একটা কথা বলে, তাঁর পুরো শরীরটাই নাকি কলিজা। আর জাফর স্যারের বেলায় তাঁর পুরোটাই 'উৎসাহ'। এক প্রকাশক একবার লিখেছিলেন স্যার ডেইলি যতগুলো অটোগ্রাফ দেন সেগুলো যদি শব্দ সংখ্যায় সাজানো যায় তাহলে হয়তো প্রতিদিন একটা করে উপন্যাস লিখতে পারতেন। তবে তিনি এতোটা লেখেন না। তিনি তাঁর পুর সময় দেন উৎসাহ নামক বটিকা বিতরণ করার জন্য। হাজার হাজার তরুণকে তিনি প্রতিদিন অনুপ্রাণিত করেন। প্রতি ১৪ দিন অন্তর দেশের পরিস্থিতি নিয়ে কলাম লেখেন। তরুণদের উৎসাহ দেন। কোন ১০ টা ছেলেমেয়ের গ্রুপও যদি ভালো কোন কাজের আইডিয়া নিয়ে সিলেটে স্যারের কক্ষে চলে যান দেখবেন স্যার আপনাদের সাথে যুক্ত হয়ে গেছেন। স্যার এমনই।
চাকরি
বেল কমিউনিকেশন রিসার্চকে বলা হতো দুনিয়ার এক নম্বর গবেষণা প্রতিষ্ঠান। সেই ল্যাবে পদধূলি দিয়ে এই দেশের মাটিকে ধন্য করতে পেরেছেন যে কয়জন বাঙালি, তাদের মধ্যে অন্যতম একজনের নাম জাফর ইকবাল। সেই লাখ টাকার চাকরি ছেড়ে দেশে ফিরে মাত্র কয়েক হাজার টাকা বেতনের বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার হয়েছেন, শহরের প্রাণকেন্দ্রে বসে খ্যাতি উপভোগ করেননি, সিলেটের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়কে নিজ হাতে গড়ে তুলেছেন। তাঁর নিজ হাতে গড়া বিদ্যাকেন্দ্র গবেষণা আর আবিস্কারে ছাড়িয়ে যায় দেশের বহু নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়কে।
নিরপেক্ষ
হয়তো এই একটা কারণেই স্যারকে সবচাইতে বেশি ভালো লাগে। স্যার অন্য সব বুদ্ধিজীবিদের মত তথাকথিত নিরপেক্ষতার মুখোশ পরেন না, সাদাকে সাদা-কালোকে কালো বলেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হবার সময় বিএনপি-জামাতকে সরাসরি আক্রমণ করে লিখেছেন-বলেছেন, এতে উনার কাটতি বাড়ুক বা কমুক তা নিয়ে ভাবেননি। স্যার যুদ্ধাপরাধীদের মিডিয়াতে কখনো কথা বলেন না, একবার দিগন্ত টিভির এক সাংবাদিককে ভৎসনা করে স্যার প্রকাশ্যেই বলেন- 'আপনি একটা ইয়ং মানুষ, আপনি জামাতের ইসলামের জন্য কাজ করেন, আপনার লজ্জা করে না?'
এটাই জাফর ইকবাল। যখন একে একে ব্লগার হত্যা হচ্ছে, একজন সুশীলও মুখ খোলার সাহস পাচ্ছে না তখনো সোচ্চার একজন জাফর ইকবাল। পরম মমতায় লিখেছেন অসংখ্য কলাম। আমার ভাইদের রক্তে যখন রাজপথ ভিজেছে তখন কেউ ছিলো না পাশে, না কোন সরকার, না কোন কবি,সাহিত্যিক কিংবা বুদ্ধিজীবি। মৃত্যু পরোয়ানা মাথায় নিয়ে সাথে ছিলেন একজন জাফর ইকবাল।
বিজ্ঞানমনস্ক জাতি গড়ে তোলার প্রত্যয়
এ দেশের ছেলে মেয়েরা বিজ্ঞান পড়তে চাইতো না একটা সময়। এখন দেশে হয় গণিত অলিম্পিয়ার্ড, ফিজিক্স-কেমেস্ট্রি অলিম্পিয়ার্ড। গণিতে আমাদের ছেলেরা সম্মান নিয়ে আসছে, এর সবকিছুকে একটা শব্দে প্রকাশ করতে বললে সেই শব্দটা হবে মুহম্মদ জাফর ইকবাল।
মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে আপোষহীন
আমাদের প্রজন্মের বেড়ে ওঠার সময়টাতে ছিলো জামাত শিবিরের কিশোরকন্ঠের যুগ। সেই অন্ধকার সময়ে মুক্তিযুদ্ধের কথা গল্প, উপন্যাসেরর ভেতর দিয়ে একেবারে ছোট ছোট বাচ্চাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া হয় মুক্তিযুদ্ধের গল্প। এই কাজটা করার ক্ষেত্রে কান্ডারি ছিলেন জাফর ইকবাল স্যার। ১৯৫২ থেকে ২০১৭, স্যারের বয়স ৬৫। মনে মনে হিসেব কষি, ফিদেল কাস্ট্রো ৯০ পযর্ন্ত দেশ চালিয়েছেন। একজন জাফর স্যার কি আরো তিরিশটা বছর সুস্থভাবে আমাদের আলো দিয়ে যেতে পারবেন না? আমাদের সবার একটু একটু আয়ু নিয়ে হলেও স্যার শতায়ু হোন। জাতিটাকে লাইনে রাখতে এই লাইটহাউজটা খুব দরকার!