পাহাড়ের চূড়ায় কিন্ত আমি একদিনে উঠিনি, আমাকেও একদম নীচ থেকেই কষ্ট করে উঠতে হয়েছে। আমি আশাবাদী মানুষ, ব্যর্থতার গল্পগুলো বলতে আমার ভালো লাগে না। নইলে অজস্রবার প্রত্যাখ্যানের যন্ত্রণা আমিও সয়েছি..."

"আমার জন্মের ব্যপারটা আমার কাছেই খুব মিরাকল লাগে। যখন আমি আমার মায়ের পেটে, তখন মা ছিলেন আমার নানার বাড়ীতে। সেখান থেকে তাকে আমার দাদারবাড়ীতে পাঠানো হলো, তখন একদম বেবি হবে হবে অবস্থা। দাদার বাড়ীতে এসে দেখেন আমার ফুপুর বেবি হবে, তখনকার লোকজন কিছু কুসংস্কার মেনে চলতো, এক বাড়ীতে দু’টো বাচ্চা জন্ম নিলে নাকি অমঙ্গল হয়, এরকম ভাবতো অনেকে। আবার নৌকায় করে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে মা গেলেন নানারবাড়ী। সেখানে আরেক ঘটনা, আমার মামীরও তখন বাচ্চা হবে, একই সময়ে। আমার নানা মা’কে আর টানাহেঁচড়া করতে দিলেন না, আমার জন্ম হলো নানারবাড়ীতেই।

আমার জন্ম হয়েছে অক্টোবরের চার তারিখে সন্ধ্যায়, আমার জানামতে। এটা সঠিক তারিখ কিনা আমাদের জানা নেই ঠিকভাবে, কারণে একাত্তরে পাকিস্তানী আর্মিরা আমাদের বাড়ী পুড়িয়ে দিয়েছিল, কাগজপত্রও সব পুড়ে গিয়েছিল। পাঁচ ভাই তিন বোনের মধ্যে আমি সবার ছোট। আগে গ্রামের বাড়ীগুলোতে আঁতুড়ঘর বলে আলাদা একটা জায়গা থাকতো, যেখানে সন্তানসম্ভবা মহিলাকে ওখানেই রাখা হতো। আমার তখন জন্ম হয়েছে, নাম রাখা হয়েছে পুলক।

এক সন্ধ্যের ঘটনা, আমার নানা মামা সবাই এশার নামায পড়তে গেছেন, তখন তো কারেন্টও ছিল না গ্রামে। আমার এক খালা আঁতুড়ঘরে এসে দেখেন আমি বিছানায় নাই। সবাই হারিকেন জ্বালিয়ে খুঁজছে, পুরুষেরা মসজিদ থেকে ফেরার পরে হ্যাজাক লাইট আনা হলো। কিছুক্ষণ পরে আমাকে পাওয়া গেল আঁতুড়ঘর থেকে অনেকটা দূরে, পুকুরপাড়ে একটা ক্ষেতের মধ্যে। যেভাবে কাঁথা মুড়িয়ে আমাকে শুইয়ে রাখা হয়েছিল, ওভাবেই পড়ে আছি আমি, আর আমার পাশে বসে আছে একটা বাঘডাশ! এই গল্পটা আমি হূমায়ুন আহমেদকে বলেছিলাম, উনি উনার একটা বই আমাকে গিফট করে লিখেছিলেন- “জাহিদ, বাঘডাশের হাত থেকে তো বেঁচেছো, মানুষের হাত থেকে কি বাঁচতে পারবে?”

পড়ালেখায় খুব বেশী মনযোগ ছিল না আমার। কোন লক্ষ্যও ছিল না। যা দেখতাম তা’ই হতে ইচ্ছে করতো, আকাশে প্লেন উড়তে দেখলে পাইলট হতে চাইতাম, ইচ্ছে করতো কাজী সালাউদ্দিনের মতো ফুটবলার হবো, আর্মি হতে চেয়েছি, অভিনেতা হতে চেয়েছি, তবে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হতে চাইনি কখনও, এগুলো বেশী পরিশ্রমের কাজ মনে হতো আমার কাছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অঙ্গভঙ্গি করতাম একসময়। স্ট্রাগলিং পিরিয়ডটায় যখন আমি ছিলাম, তখন খুব কান্না পেলে আয়নার সামনে চলে যেতাম, শুধু এটা দেখার জন্যে যে কান্নার সময় আমার মুখের বলিরেখাগুলো দেখতে কেমন হয়। আয়নার সামনে দাঁড়ালে কান্না অটোমেটিক থেমে যেতো।

'আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অঙ্গভঙ্গি করতাম'

মেট্রিক-ইন্টারমিডিয়েট তো পাশ করলাম, এরপরে আর পড়ার ইচ্ছে ছিল না। বড় ভাইবোনেরা তখন সবাই যার যার জায়গায় প্রতিষ্ঠিত, কেউ ভালো ভালো প্রতিষ্ঠানে পড়ছে। আমার আম্মা আমাকে কিছু কথা বলেছিলেন- “বাবারে, ঈদের সময় তোর ভাইবোনেরা সবাই আসবে বেড়াতে, কেউ কার নিয়ে আসবে, কেউ মাইক্রো নিয়ে, তুই ওদের ব্যাগ ট্যাগ নামিয়ে দিবি, কিছু টাকা পয়সা দেবে, এটা দিয়েই তো তোর চলা লাগবে। তুই আমার ছোট ছেলে, এটা তো আমি মেনে নিতে পারবো না।”

কিন্ত আমার তো পড়তে ইচ্ছে করে না, নাটক করতে ইচ্ছে করে। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে চান্স পেলাম না, ঢাকা কলেজে ভর্তি হলাম, কারণ ঢাকায় তো থাকতে হবে নাটকে অভিনয় করতে হলে। সেখানেও ভালো লাগলো না, জগন্নাথে ভর্তি হলাম। কিন্ত পড়ালেখার সঙ্গে সম্পর্ক নেই কোন। বাবা তখন রাগ করে টাকা পাঠানো বন্ধ করে দিলো।

সিরাজগঞ্জে থাকার সময় থেকেই থিয়েটারের সঙ্গে আমার সম্পর্ক। সেখানেই একটা নাটকে আমাকে প্রথম রোলটা দেয়া হলো, একজন গ্রামবাসীর, আমাকে শুধু ‘জ্বী হুজুর, জ্বী হুজুর’ বলতে হবে। রিহার্সালে ওই জ্বী হুজুর বলাটাই হয়তো কারো ভালো লেগেছিল, তখন বলা হলো, পুলককে জমিদারের ছোটভাইয়ের রোলটা করুক। জমিদারের চরিত্রে যিনি ছিলেন, তিনি তখন সিরাজগঞ্জের থিয়েটারপাড়ায় খুব নামকরা অভিনেতা। তো, তিনি একটা পরীক্ষার জন্যে আটকে গেলেন, আসতে পারলেন না। সৌভাগ্য বলুন কিংবা দুর্ভাগ্য; মেইন রোলটা আমাকে দেয়া হলো।

বিটিভিতে আমি প্রথম নাটক যেটা করি, সেটার নাম ‘জীবন যেমন’। সেটার জন্যে অডিশন দিয়ে পাশ করতে হয়েছিল। বিটভির নিয়মই ছিল সেটা। তার আগে আমি তারিক আনাম খান, তৌকির আহমদদের সঙ্গে থিয়েটার করেছিলাম। আপনি হয়তো ভাববেন, জাহিদ হাসানের চলার পথটা বুঝি খুব সহজ ছিল, কন্টকমুক্ত ছিল, আসলে কিন্ত তা না। সেদিন একজন আমাকে বলছে, আপনি তো পাহাড়ের চূড়ায় থাকেন, আমরা থাকি নীচে, আপনি তো আমাদের দেখবেন না। আমি বললাম, পাহাড়ের চূড়ায় কিন্ত আমি একদিনে উঠিনি, আমাকেও একদম নীচ থেকেই কষ্ট করে উঠতে হয়েছে। আমি আশাবাদী মানুষ, ব্যর্থতার গল্পগুলো বলতে আমার ভালো লাগে না। নইলে অজস্রবার প্রত্যাখ্যানের যন্ত্রণা আমিও সয়েছি।

'জীবন যেমন' নাটকে জাহিদ হাসান

আমার ক্যারিয়ারটা আমি একা গড়িনি, অজস্র মানুষের অবদান আছে এটার পেছনে। ইঞ্চি বাই ইঞ্চি অনেকের সাহায্য নিয়ে আমি এগিয়েছি। সিরাজগঞ্জে আমার প্রথম থিয়েটারে যে মানুষগুলো সবার আগে আমার হাতটা ধরেছে, তাদের কথা আমি ভুলবো কিভাবে? এখানে আসার পরে তারিক আনাম খান আমাকে গ্রুপে নিলেন। আমার কো আর্টিস্ট যারা ছিলেন, তারা হেল্প করতেন আমাকে, তারপরে প্রডিউসার, মাহবুবুল আলম নাম- তাঁর কথা না বললেই না। আবুল হায়াত আঙ্কেল, হুমায়ূন আহমেদ, নূর ভাই(আসাদুজ্জামান নূর), আলী জাকের, ফরীদি ভাই, আফজাল ভাই- প্রত্যেকটা মানুষ আমাকে একেকরকম ভাবে সাহায্য করেছে। আবদুল লতিফ বাচ্চু এবং আনোয়ার হোসেন বুলু- এরা আমাকে প্রথমদিকে কাজের সুযোগ করে দিয়েছে।

আমি যখন অভিনয়ে আসি, পরিবারের সবাই যে খুব সাপোর্ট করেছে এমনটা না। ছেলে অভিনয় করবে এটা আমার মা নিজেই চাইতেন না। ভাইবোনেরাও সবাই খুশী ছিলেন না এই সিদ্ধান্তে। আমার এক ভাই আমাকে একদিন ডেকে বললেন, শোন পুলক, জীবনে যদি চোরও হবি ঠিক করিস, তাহলে এক নম্বর বা দুই নম্বর চোর হবি। মাঝামাঝি কিছু থাকার দরকার নাই, লোকে যাতে মনে রাখে তোকে। ভাইয়ার ওই কথাটা আমি সবসময় মেনে চলি। আসলেই যেকোন কিছু করলে বড় কিছুই করা উচিত, আমি বড় কিছু হইনি, কিন্ত অ্যাভারেজ কিছুও হতে চাইনি। অনেক তো কাজ করেছি, এরমধ্যেও কিছু একদম মনে গেঁথে আছে। আজ রবিবার বলুন, মেড ইন বাংলাদেশ বা শ্রাবণ মেঘের দিনই বলুন।

আমার প্রথম ভালোলাগা ছিল ‘সমাপ্তি’ নাটকটা। ইনোসেন্ট একটা রোমান্টিক টাইপের চরিত্র ছিল আমার। তারপর স্টেজের বিচ্ছু। খাবার তো আমরা অনেক খাই, কিন্ত ক্ষুধা পেটে নিয়ে আপনি যেটা খাবেন, সেটার স্বাদই আপনার কাছে শ্রেষ্ঠ মনে হবে। আমার কাছেও ব্যপারটা তেমন। আমি একেকটা চরিত্রে যখন অভিনয় করি, প্রথম প্রেমের মতোই সেটাকে ভালোবাসার চেষ্টা করি সবসময়। তবে আমার ভালোলাগা বা ভালোবাসার জায়গাটা একটু ভিন্ন, বা সবার যেটা ভালো লাগে, সেটা আমারও ভালো লাগতে হবে এমন কোন কথা নেই। আমার নিজের ভালো লাগার একটা ব্যপার থাকে, কাজ বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সেটাকেই আমি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেই।

আমি কাজ করি আমার ভালো লাগা থেকে। নাটকটা এখন আমার কাছে প্রফেশন হয়ে গেছে, শুরুটা হয়েছিল ভালোলাগা থেকেই। ফিল্মটা ওই অর্থে আমার কাছে প্রফেশন না, এখনও ভালোলাগার জিনিস, একারণেই ফিল্ম বাছাই করতে আমি খুব সতর্ক থাকি। ভালো সিনেমা তো হচ্ছে, হয়তো শুরুতে গল্পটা আমাকে কনভিন্স করতে পারেনি, বা কোথাও হয়তো ডিরেক্টর আমার চেয়ে ভালো কাউকে সেইসব চরিত্রে নিয়েছেন- এটাও কারণ হতে পারে সিনেমায় আমাকে কম দেখা যাওয়ার।"

জাহিদ হাসান, আমাদের প্রজন্মের সবচেয়ে মেধাবী অভিনেতাদের একজন। তাঁর জীবনের গল্প জানার বা শোনার আগ্রহ আমাদের দর্শক বা পাঠকদের অনেকদিনের। আপাদমস্তক একটা ভালো মানুষ হিসেবেই তাকে চেনে সবাই। অভিনয় ক্যারিয়ারের বয়স প্রায় তিন দশক হয়ে গেছে, টিভি পর্দায় অজস্রবার তিনি আমাদের হাসিয়েছেন, কাঁদিয়েছেন। সংখ্যায় কম হলেও, অভিনয় করেছেন সিনেমাতেও। সেখানেও রেখেছেন নিজের দারুণ প্রতিভার ছাপ। মোস্তফা সরওয়ার ফারুকীর সিনেমা ‘শনিবার বিকেল’ এ’ও অভিনয় করেছেন তিনি। তাঁর জীবনের অজানা কিছু গল্পকেই ‘এগিয়ে চলো’র পাঠকদের জন্যে সাজিয়ে উপস্থাপন করা হলো আজ। শুভকামনা জাহিদ হাসানের জন্যে। এভাবেই আরও অনেক বছর আমাদের বিনোদিত করে যাবেন তিনি, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। 

কৃতজ্ঞতা স্বীকার- নিউজ২৪, থিয়েটার থ্রেড

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা