নারী দিবসের খোঁজ অধিকাংশ রাখলেও, নারীর প্রতি হওয়া নির্যাতন ও সহিংসতা প্রতিরোধ নিয়ে যে আন্তর্জাতিক একটা দিবস আছে, সেটি হয়তো অনেকেই জানেন না।

১৯৮১ সাল থেকে বিশ্বজুড়ে প্রতি বছরের ২৫শে নভেম্বর আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালিত হয়। ল্যাটিন আমেরিকায় নারীদের এক সম্মেলনে এই দিবসের ঘোষণা এসেছিল। এরপর সময়ের সাথে সাথে দিবসটি বিস্তৃত হয়েছে ধীরে ধীরে, জাতিসংঘ দিবসটি পালনের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয় ১৯৯৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর। আমাদের দেশেও সে বছর থেকেই সীমিত পরিসরে পালন করা হয় এই দিবসটি, কিন্ত আমজনতার সিংহভাগই এই দিবসের ব্যাপারে জানে না, জানে না এর পটভূমি বা গুরুত্ব সম্পর্কেও।

নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা গোটা বিশ্বেই একটি গুরুতর সমস্যা। পুরুষতান্ত্রিক পৃথিবীর নির্মম ছোবলে ঘরে কিংবা বাইরে প্রতিনিয়তই নির্যাতনের শিকার হতে হয় নারীকে। সময় বদলাচ্ছে, শিক্ষার হার বাড়ছে পুরো পৃথিবীজুড়ে, বাড়ছে সচেতন মানুষের সংখ্যাও। তবু এই আদিম অপরাধটির মাত্রা কমছে না, কমছে না এর ভয়াবহতাও। আফ্রিকান এবং এশিয়ান দেশগুলো, যেখানে শিক্ষার হার কম, দারিদ্র‍্যতার পরিমাণ বেশি, সেখানে নারীদের ওপর নির্যাতনের মাত্রাটাও বেশি। সবচেয়ে অবাক করার মতো ব্যাপার হচ্ছে, ডমেস্টিক ভায়োলেন্স বা নারীর ওপর শারীরিক নির্যাতনের অন্যতম কুরুচিপূর্ণ অধ্যায়টাকে অনেক দেশে অপরাধ বলেই গণ্য করা হয় না!

বাংলাদেশের কথাই ধরা যাক, ডমেস্টিক ভায়োলেন্সের নির্মম ঘটনাগুলো এখানে চাপা পড়ে যায় 'সাংসারিক ঝামেলা'র আড়ালে। এখানে নির্যাতিতা নারীটিকে সমাজ এবং পরিবারের পক্ষ থেকে চাপ দেয়া হয় আইন-আদালতের আশ্রয় না নিতে, অন্যায় মেনে নিয়ে সংসার করতে। স্বামী স্ত্রীর মনোমালিন্য সব জায়গায় হয়- এমন ঠুনকো এবং বিভ্রান্তিকর উদাহরণ দেখিয়ে পুরো ঘটনাটাকে ধামাচাপা দিতে দেখা যায় অহরহ। আর প্রতিবাদী নারীর প্রতি আমাদের সমাজের যে দৃষ্টিভঙ্গি, তাতে নারীরাও সাহস করে ওঠে না অন্যায়ের বিচার চাওয়ার, মুখ বুঁজে সংসার ধর্ম পালন করে যাওয়াটাকেই তারা নিয়তি বলে ধরে নেয়। স্বামী চাইলেই তার স্ত্রীকে নির্যাতন করতে পারে- এরকম মানসিকতাই ঢুকিয়ে দেয়া হয় আমাদের মেয়েদের মাথার ভেতর।

নারীর প্রতি সহিংসতা বলতে অনেকেই শুধু শারীরিক নির্যাতনের কথা ভাবেন, ব্যাপারটা মোটেও এরকম নয়। ধর্ষণ, মারধরের পাশাপাশি কটুক্তি করা, ইভটিজিং করা, অনলাইন বা অফলাইনে হ্যারাস করা- সবকিছুই এই সহিংস আচরণের মধ্যে পড়ে। অনলাইন জগতে একজন নারীকে প্রতি মুহূর্তে যেসব বিব্রতকর পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয়, সেটা একজন পুরুষ হয়তো কল্পনাও করতে পারবে না। বিশেষ এই দিবসটার প্রতিপাদ্যই হচ্ছে এসব সহিংসতার প্রতিবাদ করা, এসব নিয়ে সচেতনতা তৈরি করা, অথচ খুব বেশি মানুষের দ্বারপ্রান্তে এই দিবসের কথা পৌঁছে দেয়াও যাচ্ছে না।

নারী দিবসকে সামনে রেখে দেশ এবং বিদেশের বিভিন্ন কর্পোরেট হাউজগুলো নজরকাড়া প্রচারণা চালায়, বিজ্ঞাপন তৈরি করে। কিন্ত ২৫শে নভেম্বরের এই আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবসে তাদের উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ দেখা যায় না। নারীর প্রতি সহিংসতা ব্যাপারটায় গ্ল্যামার নেই, এজন্যে হয়তো ব্র‍্যান্ড কোলাবরেশনও থাকে না। তবে এবছর ব্যতিক্রমী এক নজির তৈরি করেছে ইস্পাহানী গ্রুপের জেরিন প্রিমিয়াম টি। জিরো টলারেন্স হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে তারা নারীর ওপর হওয়া সব রকমের সহিংসতা আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আহবান জানিয়েছেন। বাংলাদেশের বাস্তবতায় এটা বেশ অভিনব এক দৃষ্টান্ত।

জেরিন প্রিমিয়াম টি'র এই সহিংসতাবিরোধী প্রচারণায় যুক্ত হয়েছেন সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার এবং সেলিব্রেটিরাও। তারাও আওয়াজ তুলেছেন সহিংসতার বিরুদ্ধে, কথা বলেছেন নারীর সঙ্গে ঘটে যাওয়া নানা রকম নির্যাতন নিয়ে, এসব থেকে পরিত্রানের উপায়টাও বলেছেন তারা- এই সহিংসতা নিয়ে কথা বলতে হবে, প্রতিবাদ করতে হবে নিজ নিজ জায়গা থেকে। এটাকে ট্যাবু হিসেবে রেখে দেয়া যাবে না, ভয় পাওয়া চলবে না। সমাজে পরিবর্তন আনতে চাইলে, এদেশের নারীর ভাগ্যের বদল ঘটাতে চাইলে, নারীদের জন্য নিরাপদ শহর, নিরাপদ রাষ্ট্র গড়তে চাইলে এসব অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়া যাবে না কোনোভাবেই। আমাদের মায়েরা, আমাদের বোনেরা যদি আমাদের কারনেই ঘরে কিংবা বাইরে নিজেদের নিরাপদ ভাবতে না পারে, সেটা তো আমাদেরই ব্যর্থতা।

অন্যরকম এই প্রতিবাদের শুরুটা হয়েছে জেরিন প্রিমিয়াম টি'র হাত ধরে, পথটা তৈরি করে দেয়ার জন্য তারা সাধুবাদ পাবেন। ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই এই দিবস, এবং এই সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে আরও অনেক কর্পোরেট ব্র‍্যান্ড কাজ করবে, প্রচারণা চালাবে, সচেতনতার বার্তা ছড়িয়ে দেবে দেশের আনাচে কানাচে- এমনটা আমরা আশা করতেই পারি।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা