১৫ই আগস্ট যতবার আসবে এই পৃথিবীর বুকে, ততবার জিয়া উঠে আসবে। আসতে হবে, আমরা আনবোই। কিন্তু কেন আনবো?

১) এক ভাই দেখলাম বলছেন যে, শোক দিবসে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কথা হওয়া উচিত। কিন্তু জিয়াকে নিয়ে কথা বলি আমরা। জিয়াকে নিয়ে কথা বলে তাকে কেন স্পেস দিচ্ছি আমরা।

এগুলো হলো চিকন বুদ্ধির ফসল। ১৫ই আগস্ট যতবার আসবে এই পৃথিবীর বুকে, ততবার জিয়া উঠে আসবে। আসতে হবে, আমরা আনবো। ৭৫ থেকে ৯৬, ২১ বছর অনেক নতুন ইতিহাস লেখা হয়েছে। আফসোসের বিষয়, এখনও লেখা হয়। আমাদের উদার সরকার পিনাকীদের মতো পেইড এজেন্টদেরকে ইতিহাস লেখবার লাইসেন্স দিয়ে রেখেছেন, সে লাইসেন্স পেয়ে তারা নতুন করে ইতিহাস লিখছেন যে, মার্কিন নৌ সপ্তম নৌ বহর নাকি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাঠানো হয়নি। এমন আরও অনেক কিছুই। 

পরেশ সাহা’র ‘মুজিব হত্যার তদন্ত ও রায়’ বইটি থেকে কিছু তথ্য উপাত্ত দিচ্ছি। জানি, এতেও পিনাকিদের কিছু যায় আসবে না। রাষ্ট্রদূত বার্নিকটের বাড়িতে যিনি দাওয়াত খেতে যান প্রায়ই, তাকে ট্যাবলেট বানিয়ে গুলে খাওয়ালেও কি প্রুভুভক্ত অভ্যাস চলে যাবে ভেবেছেন? ১৯৭৪ সালে পরেশ সাহা ঢাকায় আসলে, তাঁর সাথে শ্রদ্ধেয় আব্দুল গাফফার চৌধুরীর কথা হয়। গাফফার চৌধুরী উদ্বিগ্ন কন্ঠে জানান, মার্কিন দূতাবাসে প্রায় প্রতি রাতে মদের আড্ডা বসে, এবং অনেক সামরিক অফিসার সেখানে অংশগ্রহন করেন। সে সময় ঢাকায় দুইজন আমেরিকান নারী চরিত্র বেশ রহস্যময় ভূমিকা পালন করেন। তাদের নাম ছিলো মিস মিসিসিলা ও অপরজন মিস মেরী। ধারণা করাই যায়, যে এগুলো তাদের ছদ্মনাম। ২৬ বছর বয়সী, রুপসী মিস মিসিসিলিকে তাহের উদ্দিন ঠাকুরের গাড়িতে, ওবায়েদুর রহমানের সহিত তো দেখা যেতোই, কোন কোন সামরিক অফিসারকে সঙ্গ দিতো বলেও জানা গিয়েছিলো।

‘ফার ইস্টার্ন ইকনমিক রিভিউ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিলো যে, মানিক মিয়ার বাসভবনে মুজিব হত্যাকারীদের শেষ বৈঠক হয়, সেখানে মেজর ডালিম, মেজর ফারুক, তাহের উদ্দিন ঠাকুরের সহিত সেই মিস মিসিসিলিও উপস্থিত ছিলেন। শুধু তাই নয়, মুজিবকে হত্যার পরে বঙ্গভবনে যে আনন্দ-উৎসবের আয়োজন করা হয়, তার পরিচালনাতেও ছিলেন মিস মিসিসিলি। চিলিতে যখন আলেন্দ হত্যা কিংবা আত্মহত্যা সংগঠিত হয়, তখন সেখানে মার্কিন দূতাবাসের সচিব পর্যায়ের দায়িত্বে ছিলেন যিনি, ১৯৭৪ সালে তিনিই বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদুত হয়ে আসেন। তার নাম, ডেভিস ইউজিন বোস্টার।

মুজিব হত্যার পরে ক্ষমতা হাতে নিয়ে মোশতাক ডেভিস ইউজিন বোস্টারের সাথে সাক্ষাত করেন। এবং ভারতের প্রভাব থেকে মুক্তির জন্য তিনি ভিক্ষুকের মতো বোস্টারের হাত ধরে কাকুতি মিনতি করেন। সেই সাথে মোশতাক বলেন যে, ‘আজকের এই সুযোগ হেলায় হারানো উচিত হবে না। কারণ ১৯৭১ সালের মে মাসে আমেরিকান অফিশিয়ালসদের সাথে কোলকাতায় বসে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে কম্প্রোমাইজেশন নিয়ে যে চিন্তা ভাবনা তারা করেছিলেন, সেটি বাস্তবায়ন করতে পারেননি তিনি, তাই আজকের এই সুযোগ তিনি হারাতে চান না। বোস্টার ওয়াশিংটনে যে কনফিডেনশিয়াল লেটারটি (ক্যাবল) পাঠান সেখানে শেষের দিকে তিনি লিখেন যে, ‘আমি বিশ্বাস করি, এটাই হবে সবচেয়ে প্রভাবশালী এবং একই সাথে সবচাইতে সহজভাবে এই সরকারের সাথে সৌহার্দপূর্ন সম্পর্ক তৈরী করবার। নতুন এই সরকারের রাষ্ট্রপতি সে সকল পরিবর্তন আনবার প্রতি একনিষ্ঠ, যে পরিবর্তনগুলো আমরা দেখবার ইচ্ছা রাখি’। 

২০০৫ সালের ১৬ই আগস্ট, ডেইলি স্টারে আমেরিকান সাংবাদিক ল্যরেন্স লিফশুলজ, বোস্টারের সাথে তার সাক্ষাতকার নিয়ে লিখেন, ‘Mustaque group approached US embassy in Dhaka’ সেখানে দেখা যায়, ৭৫ এ বোস্টার সরাসরি লিফশুলজকে জানান, ৭৪ এর নভেম্বর থেকে শুরু করে ৭৫ এর জানুয়ারী পর্যন্ত মোশতাকদের এই দল নিয়মিত আমেরিকান এম্বাসির সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেছে এবং তাদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেছে। বোস্টার এরপর জানান, তিনি এম্বাসির সকলকে জানিয়ে দেন যাতে এই ক্যু এর নেপথ্যে যারা তাদের সাথে যোগাযোগ না রাখতে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, তিনি তিন মাস এম্বাসির সাথে ক্যু এর নেপথ্যে যারা তাদের সাথে সম্পর্ক রাখতে দিলেন, এরপর এসে তিনি মানা করলেন। তিন মাস কি যথেষ্ট সময় নয় পরিকল্পনার জন্য?

আরও মজার ব্যাপার হলো, তিনি সকলকে যোগাযোগ করতে মানা করে, সিআইএ স্টেশন চীফ, ফিলিপ চেরীর কাছে ব্যাপারটা এগিয়ে দিলেন। অর্থাৎ, আমি কিছু জানি না। কিছু হোক বা না হোক, এম্বাসির কোন দোষ নেই। আমেরিকান লেখক রজার মরিস, পরবর্তিতে হেনরি কিসিঞ্জারের ন্যাশনাল সিকিউরিটি এডভাইজর, এনার সাক্ষাতকার নিয়েছিলেন ল্যরেন্স লিফশ্যুলজ। মরিস তাকে জানান, '৭৫ এর শুরু দিকে একটি বই লেখবার জন্য কিসিঞ্জারের কাছের একজনের সাক্ষাতকার নিচ্ছিলাম। তিনি তখন আমাকে জানান, আমেরিকান ফরেইন পলিসির এনেমি লিস্টে কিসিঞ্জারের তিনজন ঘৃনার লোক আছেন। তারা হলেন, চিলির আলেন্দ, ভিয়েতনামের থিউ আর বাংলাদেশের মুজিব।' 

এই ল্যরেঞ্জ লিফশ্যুলজ ২০১১ সালের মার্চের ১৪ তারিখে বাংলাদেশে আসেন, এবং কর্নেল তাহেরের গোপন বিচার নিয়ে রুলের শুনানীতে বক্তব্য প্রদান করেন। সেদিন তিনি বলেন, ‘He was kind of mastermind in this. Zia was in the shadows, but he was playing his cards. Okay? I’m not telling that he was the single person. There was many people involved, the majors and others. But, he played a significant role’. 

১৯৭৬ সালের ৩০মে, The Sunday Times পত্রিকায় বঙ্গবন্ধু হত্যার অন্যতম আসামী মেজর ফারুক বলেন, খন্দকার মোশতাকের ভাগ্নে ও আমার ভায়রা কর্ণেল রশীদ প্রথম আমার কাছে প্রস্তাব নিয়ে আসে যে, মুজিবকে সরিয়ে মোশতাককে বসানোর জন্য, আমি তাতে রাজী হই। সেই সাথে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকেও এ প্রস্তাব জানাই। এ পরিকল্পনা গ্রহনের পর মোশতাক ও জিয়া আমাদেরকে স্বাগত জানান ও পরিকল্পনায় সম্মত হন’।

ফারুক তখন চ্যালেঞ্জ করে বলেন, ‘সাহস থাকলে তাকে যেনো মুজিব হত্যার আসামী হিসেবে বিচার কার্যে সোপর্দ করে’। মেজর রশীদও ২১শে এপ্রিল ‘গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় বলেন, ‘জিয়া সাহেব যদি তাদের দাবী মেনে না নেন, তাহলে বঙ্গবন্ধু ও অন্য নেতাদের হত্যার ব্যাপারে জিয়ার যে ভূমিকা রয়েছে, তারা তা প্রকাশ করে দিবে’। না, জিয়া তাদের সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহন তো করেননি, উলটো তাদেরকে বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে সেক্রেটারি হিসাবে পাঠান, লিবিয়াতে লবিং করে দুজনকে ক্যাবিনেট মন্ত্রীর সমান মর্যাদার আসীনে উন্নীত করেন। জিয়া যদি বঙ্গবন্ধু হত্যার সাথে জড়িত না হয়ে থাকেন, তাহলে জাতীয়তাবাদীদের কাছে প্রশ্ন রইলো, কেনো তিনি খুনী ফারুক আর রশীদের চ্যালেঞ্জ গ্রহন করলেন না? 

১৯৭৬ সালের ২রা আগস্ট এন্থনি মাসকারেনহাসকে দেয়া কর্নেল ফারুক, আর কর্নেল রশীদের বিখ্যাত সেই সাক্ষাতকারে দেখা যায়, তারা নিজেদেরকে খুনী হিসেবে তো স্বীকার করছেই। সাথে জানাচ্ছেও যে, কর্নেল ফারুক ১৯৭৫ সালের ২০ মার্চ সন্ধ্যায় জিয়াউর রহমানের সাথে দেখা করে, এবং তাকে মুজিব হত্যার পরিকল্পনা জানালে জিয়া বলেন, তোমরা এগিয়ে যাও। ৭৫ এর ১৫ই আগস্ট সেনাবাহিনীর একাংশ নিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে ব্রিগেডিয়ার সাফাত জামিল বেড়িয়ে আসলে, উপ-সেনাপতি জিয়াউর রহমান তাকে থামান, পরদিন, ১৬ আগস্ট, কে এম শফিউল্লাহকে (তৎকালীন সেনাপ্রধান) সভাপতি করে মিটিং এর আয়োজন করা হয়।

সাফাত জামিল সে মিটিং এ বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে সারা বিশ্বের সামনে আমাদের সেনাবাহিনী কলংকিত হয়েছে। এ কলংক মুছবার জন্য হলেও, এই খুনের সাথে জড়িতদেরকে ধ্বংস করতে হবে। তার সাথে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ একমত হন। অত্যন্ত ধূর্ত জিয়াউর রহমান তখন বলেন, ভাবাবেগ দিয়ে পরিচালিত হলে হবে না। ভাবাবেগ দ্বারা পরিচালিত হলে দেশে গৃহযুদ্ধ অনিবার্য। এতে বিদেশী রাষ্ট্র (ভারত) হস্তক্ষেপের সুযোগ পাবে। আগামীকাল আবার আলোচনা হবে। কে এম শফিউল্লাহ জিয়ার মতের সাথে সহমত প্রকাশ করেন। পরদিনের সে মিটিং আর হয়নি, ততোক্ষনে শফিউল্লাহকে সরিয়ে জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর প্রধান। আর শফিউল্লাহকে মালয়েশিয়াতে পাঠিয়ে দেয়া হয় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত করে। 

আজকে যে হাইকোর্ট নিয়ে জিয়াউর রহমানের রেখে যাওয়া ক্যান্টনমেন্ট ভিত্তিক দল উচ্ছসিত, তারা কি ভুলে গিয়েছে, এই হাইকোর্টই ২০১১ সালে জিয়াকে ‘ঠান্ডা মাথার খুনী’ হিসেবে অভিহিত করেছে, এবং জানিয়েছে যে, জিয়া বঙ্গবন্ধু হত্যার সাথে জড়িত, একই সাথে সহস্র মুক্তিযোদ্ধা হত্যার সাথেও। আদালত বলেন, যেহেতু জিয়াউর রহমান মৃত, তাই তার শাস্তির ব্যবস্থা করা গেলো না। জাতীয়তাবাদীদেরকে এই সম্পর্কে কিছু বলবার অনুরোধ থাকবে। 

২) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মানুষটিকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, আপনার শক্তি কী? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমি আমার মানুষদেরকে ভালোবাসি’। তাকে পালটা প্রশ্ন করা হয়েছিলো, ‘আপনার দুর্বলতা কী?’ তিনি জানিয়েছিলেন, ‘আমি তাদেরকে খুব বেশী ভালোবাসি’। ভারতের সাবেক কুটনৈতিক শশাংক ব্যানার্জি বলেন, মিসেস গান্ধীর নির্দেশে যখন বঙ্গবন্ধুর কাছে গেলাম, তিনি পত্র দেখে বললেন, ‘এই জিয়াউর রহমান, ফারুক এরা তো আমার ছেলের মতোন! ছেলে কি কোনদিন বাবাকে খুন করতে পারে?’

আকাশের মতন বিশাল এক মন দিয়ে তিনি ভালোবেসেছিলেন বাঙ্গালীকে। বাংলাদেশকে। শেখ মুজিবুর রহমান সর্বপ্রথম বাঙ্গালি, যিনি নিজে বাঙ্গালী ছিলেন এবং এই দেশের মানুষদেরকে একটি দেশ, একটি শাসন ব্যবস্থা উপহার দিতে পেরেছিলেন। এর আগে পাল বংশ, মৌর্য বংশ, মুঘল, ইংরেজ, পাকিস্তানী বহু বছর আমাদেরকে বিদেশী শাসন মুখ বুজে সহ্য করতে হয়েছিলো। শেখ মুজিবুর রহমান সেই ব্যক্তি, যিনি প্রথম সাত কোটি বাঙ্গালিকে অনুধাবন করাতে পেরেছিলেন, আমরা আর বিদেশীদের প্রভুত্বকে মেনে নেবো না। আমরা মুক্তি চাই। আমরা স্বাধীনতা চাই। আর তাই, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি বলাটা এই মহামানবকেই মানায়। 

আমি খুব করে স্বপ্ন দেখি। একদিন এলাকায় এলাকায় লাইব্রেরী হবে। ছোটবড় সবাই সেখানে মুখ গুজে থাকবে। সেই লাইব্রেরীগুলোতে জ্বলজ্বল করবে বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীগুলো। আমি স্বপ্ন দেখি, একদিন ১৫ই আগস্টে ট্রাক-পিকাপে মাইক না বাজিয়ে, মোড়ে মোড়ে প্যান্ডেল টাংগিয়ে বিরিয়ানী উৎসব না করে, একদিন দলে দলে, লাখো মানুষ একদম চুপ করে ধানমন্ডি ৩২ এর সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকবো।

কোন মুক্তিযোদ্ধা যদি সেদিন কেঁদে উঠে, আমরা তাকে জড়িয়ে ধরবো, তাঁর হাত ধরে বলবো, আমরা আছি। আমরা আপনাদের ভালোবাসি। আপনাদের প্রতি আমাদের অশেষ কৃতজ্ঞতা। নিজের জীবন দিয়ে আপনারা আমাদেরকে একটি দেশ দিয়ে গিয়েছেন, সেই দেশকে আমরা স্বাধীন রাখবো, সেই দেশকে আমরা জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, অর্থনীতিতে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবো। যে ধর্মনিরপেক্ষতার স্বপ্নে বিভোর হয়ে আপনারা যুদ্ধে গিয়েছিলেন, সে ধর্মনিরপেক্ষতাকে যারা ধুয়ে-মুছে সাফ করে, দেশটাকে মৌলবাদীদের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলো, আমরা আর তাদেরকে এক মুহুর্তের জন্য এই দেশে থাকতে দিবো না। এই দেশে কোন সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু শব্দ থাকবে না। এই দেশটা আমাদের সবার। এই দেশটা হবে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ, আমাদের বাংলাদেশ।

তথ্যসূত্র:


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা