এমন শান্ত একটা মানুষের বুকের মধ্যে কী ভয়ানক সাহস ছিলো দেশের জন্য সেটা তাকে না দেখলে বোঝা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর গড়ে উঠেছে তার প্রচেষ্টায়, আজীবন তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার জন্য লড়েছেন...

মুক্তির গান। আমি নিশ্চিত বাংলাদেশের যে কোন কিশোর-তরুণ তরুণ যদি মুক্তির গান দেখেন তার বুকের মধ্যে এক ধরনের তোলপাড় হবে। আমারও তাই হয়েছিল। স্কুলে থাকা অবস্থাতেই সম্ভবত ১৯৯৬ সালে আমি এই প্রামাণ্যচিত্রটা দেখি এবং মুগ্ধ হই। করোনায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি জিয়াউদ্দিন তারিক আলীর মৃত্যুর পর আজকে সেই কথাগুলো খুব মনে পড়ছে। 

মুক্তির গানের নির্মাতা তারেক মাসুদ ও ক্যাথেরিন মাসুদ হলেও তাদেরকে এই অমূল্য সংগ্রহের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন তারিক আলী। তারেক মাসুদ ও তারিক আলী দুজনের সঙ্গেই আমার এ নিয়ে আলাপের সুযোগ হয়েছে। আর তারিক আলীকে প্রায় প্রতিটা আন্দোলনেই রাজপথে পেয়েছি। বিশেষ করে তারেক মাসুদের মৃত্যুর পর নিরাপদ সড়কের আন্দোলনে তাকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। নিরহঙ্কারী এই মানুষটা এই দেশকে কতোটা ভালোবাসতেন সেটি বলে শেষ করা যাবে না।

মুক্তির গান যারা দেখেননি দেখে নিতে পারেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একাধিকার আমরা এই সিনেমা দেখিয়েছি। আজও এই সিনেমা দেখলে বিশেষ করে গানগুলো শুনলে আমার চোখে পানি আসে। বিশেষত, বাংলাদেশের মাটি ছোঁয়ার দৃশ্য কিংবা আমার সোনার বাংলা গানে। আমি বিশ্বাস করি এই সিনেমা বুকের মধ্যে যে তোলপাড় তোলে তার নাম দ্রেশপ্রেম। এই দেশপ্রেম মানুষকে কখনো স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে যুক্ত করবে না।

যাই হোক, মুক্তির গানের কাহিনী হলো একদল সাংস্কৃতিক কর্মীকে নিয়ে। ৭১-এর রণাঙ্গনে যখন তুমুল যুদ্ধ চলছে, সনজীদা খাতুন ও ওয়াহিদুল হকের নেতৃত্বে একদল তরুণ সংস্কৃতিকর্মী একটি ট্রাকে করে শরণার্থীশিবির থেকে শরণার্থী শিবিরে ছুটে ছুটে গান গেয়ে লড়াই-সংগ্রামকে অনুপ্রাণিত করতেন। শিল্পী দলের আবার নেতা ছিলেন মাহমুদুর রহমান বেণু।

এই দলের ট্রাকে করে ঘোরার মূল দৃশ্যগুলো ক্যামেরায় ধরেছিলেন তরুণ মার্কিন বিজ্ঞাপন নির্মাতা লিয়ার লেভিন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি এই সিনেমার নির্মাণ শেষ করতে পারেননি। ফলে দুর্লভ এই দৃশ্যগুলো হারিয়ে যেতে বসেছিল।

বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউদ্দিন তারিক আলী

১৯৯০ সালে নির্মাতা তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে দেখা হয় জিয়াউদ্দিন তারিক আলীর। তিনি ছিলেন তারেক মাসুদের চাচাতো ভাই মাহমুদুর রহমান বেণুর বন্ধু। আর এই বেণুই ছিলেন একাত্তরের সেই শিল্পী দলের নেতা। তারিক আলী তখন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে লিয়ার লেভিনের প্রসঙ্গ তোলেন। জানান এই ফুটেজগুলো তিনি লিয়ার লেভিনের বাসায় দেখেছেন।

এরপর তারেক মাসুদ খুঁজে বের করেন লিয়ারকে। একদিন টেলিফোন করেন। তারেকের ফোন পেয়ে লিয়ার বলেছিলেন, এই ফোনটির জন্যই তিনি এতোবছর হয়তো অপেক্ষা করছেন। এরপর তো নতুন ইতিহাস। তারিক আলী নিজেই মুক্তির গানের ধারাভাষ্য বর্ণনা করেছেন। তিনি মজা করে বলতেন, ওয়াহিদুল হক তাকে বলেছেন, তোমার যে গলা কখনো গান গেও না।

তারিক আলীকে যারা চেনেন তারা জানেন কতোটা বিনয়ী মানুষ ছিলেন তিনি। এমন শান্ত একটা মানুষের বুকের মধ্যে কী ভয়ানক সাহস ছিলো দেশের জন্য সেটা তাকে না দেখলে বোঝা যাবে না। এই যে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর গড়ে উঠেছে তার পেছনেও তার অনেক শ্রম ছিল। আজীবন তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার জন্য লড়েছেন।

করোনা গতকাল মানুষটাকে নিয়ে গেলেন। আমি জানি না আমাদের নতুন প্রজন্ম কতোটা জানে তারেক আলীদের সম্পর্কে। এরাই তো আসল বিপ্লবী। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, থাকবে মুক্তির গান, থাকবে তারিক আলীদের বীরত্ব। পরপারে ভালো থাকবেন স্যার। স্যালুট আপনাকে।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা