অধিকাংশ প্রানীই বন্দিদশায় তাদের মানসিক ভারসাম্য হারাচ্ছে, মানসিক দিক থেকে তারা ভীষণ রকমের অসুস্থ হয়ে পড়ছে দিনকে দিন। আমরা মানুষ, আমাদেরই কি একমাত্র মানসিক ভারসম্যে সমস্যা হয়? এসব নিয়ে আমাদের কোন ভাবনা আছে কি?
চিড়িয়াখানা- এই শব্দটা নিজেই নিজেকে ব্যঙ্গ করে। চিড়িয়াখানা আমার চোখে বন্যপ্রাণীদের জেলখানা, এখানে বন্যপ্রাণীদের বিনা অপরাধেই বন্দী করে রাখা হয়। বিনোদনের খোরাক আর কসরত শেখানোর জন্য উপরি মারও দেয়া হয়। মানুষকে পৈশাচিক বিনোদন দেয়া আর অর্থ উপার্জনের জন্য সৃষ্ট চিড়িয়া জেলখানাকে সাম্রাজ্যবাদী সংরক্ষণ এবং গবেষণা কেন্দ্র নামে পাবলিক বুঝ দেয়। পৃথিবীর প্রায় সব বড় শহরে এমন জেলখানা অন্তত একটি করে রয়েছেই।
খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫০০ অব্দে প্রাচীন মিশরে এই জেলখানার অস্তিত্ব ছিল। ১২০৪ সালে ইংল্যান্ডে আনুষ্ঠানিক ভাবে চিড়িয়াখানা গড়ে উঠে। ইতিহাস আর না বলি।
এই বন্দিশালায় প্রাণীদের যতটক মহৎ উদ্দেশ্য দেখিয়ে পয়সা কামানো হয়, আসলে বিষয়টি মোটেও সেরকম মহৎ কিছু নয়। আপনার মনে এই স্বাভাবিক প্রশ্নটা যদি আসে যে, কেন মুক্ত প্রাণীকে বন্দি করে টিকিট কেটে বিনোদন দিতে হবে? কেনো তাদের আবাসস্থলে রেখেই নজরদারি আর গবেষণা করা হয় না? কাউকে জোর করে বন্দী করে তারপরে বিনোদন নেয়াটা কি সুস্থ কাজ? এই প্রশ্ন প্রায় অনেকেরই মাথায় আসে, আমি গর্বিত কারন দেশে এখনো বিবেকবান মায়াদয়া সম্পন্ন মানুষ রয়েছেন। আর যাদের এই প্রশ্ন গুলো আসে না, তাদের জন্য আমার সমবেদনা, কারন সাম্রাজ্যবাদ আর পুঁজিবাদ তাদের মস্তিষ্ক খুব ভালো রকমে পরিস্কার করে রেখেছে।
আমার প্রথম চিড়িয়াখানা দর্শন ৫ বছর বয়সে, সেই বয়সে একবার গিয়েই যা অভিজ্ঞতা হয়েছে তা থেকে একটা ভীতি সৃষ্টি হয়েছিল মনে। কারন টিভিতে দেখেছি প্রাণীগুলো বনে বাদাড়ে আর সবুজ মাঠে দুরন্ত, এখন প্রথম যখন সামনে থেকে দেখলাম এরা কেউ প্রাণচঞ্চল আর প্রাণবন্ত কোনোটিই না। এদের চোখে কান্নার দাগ, কষ্টের প্রতিচ্ছবি আঁকা শরীরের ভাঁজে ভাঁজে। এরা শুধু আর্তনাদ করে আর ক্লান্ত হয়ে ঘুমোয়, তাদের অসহায়ত্ব তাদের আচরণে পরিস্কার ফুটে ওঠে। আমার মতন অনেকেই বাচ্চা বয়সে আশা হারিয়েছেন চিড়িয়াখানা আর বন জঙ্গলের প্রাণীদের বাস্তবতা দেখে। বিশ্বাস করুন, মিরপুর চিড়িয়াখানার পাশের বোটানিক্যাল গার্ডেন বেশি বিনোদন দেয় এই জেলখানার থেকে।
অপ্রাসঙ্গিক কথা বাদ দিয়ে যদি আমরা প্রসঙ্গে ফিরে আসি দেখবো পৃথিবীতে প্রত্যেক শহরের চিড়িয়াখানার নির্মমতা নিয়ে ওয়েব ঘুরলে হাজারটার বেশি সার্চ হিট এমনিতেই পাওয়া যাবে। কেউ দেখবেন গুলি করে চিড়িয়াখানার প্রাণী মারছেন, কেউ নাচ আর সালাম দেয়া শিখানোর জন্য ইলেক্ট্রিক শক দিচ্ছে, কেউ খাবার কেড়ে নিচ্ছে, কেউবা খাবার দিচ্ছেই না, কেউ আবার প্রতিনিয়ত ডার্ট বিদ্ধ করছে, কেউ আবার প্রাণীদের শারীরিক শক্তি বৃদ্ধির অঙ্গ গুলোই কেটে নিচ্ছে, সংখ্যায় বেশি হলে মেরে ফেলছে, নিজেদের খাদ্য হিসেবে ব্যাবহার করছে। এরকম হাজারো নির্মম ঘটনা ঘটছে প্রত্যেকদিন ঠুনকো পৈচাশিক বিনোদনের নামে।
মুক্ত প্রকৃতি থেকে তাদেরকে তুলে এনে জীবনটাকে শুধু ব্যাহতই করছে না রীতিমতন অত্যাচার করা হচ্ছে জোর পূর্বক ভাবে। এর প্রভাবে প্রত্যেকটা প্রাণীর স্বাভাবিক খাদ্যাভ্যাস বদলে গিয়ে শরীরে রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে দ্বিগুণ হারে, ওজন হ্রাস পাচ্ছে, কারোর বন্দিদশায় শরীরে অপ্রয়োজনীয় ক্ষতিকর ওজন বৃদ্ধি পাচ্ছে, কেউ কেউ বিচরণের স্বল্পতার কারনে মুষড়ে যাচ্ছে। অধিকাংশ প্রানীই বন্দিদশায় তাদের মানসিক ভারসম্য হারাচ্ছে, মানসিক দিক থেকে তারা ভীষণ রকমের অসুস্থ হয়ে পড়ছে দিনকে দিন। আমরা মানুষ, আমাদেরই কি একমাত্র মানসিক ভারসম্যে সমস্যা হয়! তারাও যেহেতু প্রাণী তাদেরও সমস্যা হয়, সেটা তাদের মানসিক অবস্থানের উপর ভিত্তি করে।
কিন্তু না আমরা তাদের মানসিক দিকটার কথা অনেকেই ভাবছি না,এমনকি সেভাবে গুরুত্বও দিচ্ছি না। তারা যেমন প্রাণী আমরাও তাদের থেকে কোন অংশে বেশি না। সৃষ্টির সেরা জীব- এই উদ্ভ্রান্ত প্রলাপ শুনে সারা পৃথিবীকে শাসন করার সব রকম প্রচেষ্টা জারি রেখেছি আমরা। এই সব মারফতি মনগড়া কথায় আপনি আমি প্রকৃত পক্ষে সৃষ্টির সেরা জীব হয়ে যাই না নিশ্চয়ই, কারন নিজেদের নিজেরাই শ্রেষ্ঠ ভাবাটা অজ্ঞতা আর অহংকারী মনোভাবাপন্ন পরিবেশ তৈরি করে।
শুধু প্রজাতি হিসেবে প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মের প্রিভিলেজ পেয়েছি বিবর্তনে তাই এটা নিয়ে বাহাদুরি করার কিছু নাই। সকল প্রাণীর প্রতি একটা সহবস্থান মূলক চিন্তা প্রক্রিয়া এখন খুবই জরুরি প্রাকৃতিক ভারসাম্য টিকিয়ে রাখার জন্য। আমরা সবাই মিলেই কিন্তু প্রকৃতি, তাই তাদের মানসিক দিকটার কথা ভাবার বিষয় বটে।বন্যপ্রাণীদের মানসিক স্বাস্থ্য বন্দি হয়ে ভেঙ্গে পড়ছে সেই শুরু থেকেই। চিড়িয়াখানায় তাদের অনেকেই চেঁচাচ্ছে, লোহার গ্রিল ভেঙে ফেলতে চাইছে, খাবার খাওয়া ছেড়ে দিচ্ছে, স্বাভাবিক হাঁটা-চলাও বন্ধ করে দিচ্ছে, মনমরা হয়ে মারাও যাচ্ছে। যেকোনো প্রাণীই সাংঘাতিক মানসিক চাপে পড়লেই এমন কাজ গুলো করে।
প্রাণী স্বাস্থের প্রতি যদি খেয়াল রাখা হয়, তাহলে PETA এর এক পরিসংখ্যানে বলছে প্রত্যেক বছর শুধু ইউরোপের চিড়িয়াখানায় ৪৫০০ থেকে ১০,০৫০টি প্রাণী মারা যাচ্ছে। আমরা এটা শুনে বলতে পারি তারা যেহেতু প্রানী আর প্রত্যেকটা প্রাণীর জীবন অবসান হবেই! কথা ঠিক আছে। কিন্তু যে প্রাণী গুলো মারা যাচ্ছে তার কোনোটাই কিন্ত স্বাভাবিক কারন ছাড়াই। ইউরোপের তো স্ট্যান্ডার্ড আছে বাইরে থেকে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকার আর লোক দেখানোর। আর আমাদের দেশের মতো আরো বহু দেশ আছে যাদের চিড়িয়াখানার পরিবেশ ভিতরে এবং বাহিরে ভীষণ নোংরা সরাইখানার মতন। আর আমরা মানুষদের সাথেই যতটা অমানবিক,পশুদের সাথেতো তা আরো হাজার গুনে বেশি। আমরা আমাদের চার পাশের প্রাণীদের কখনো গুরুত্ব দিই না এবং তাদের অস্তিত্ব সংকটে পড়ছে নাকি সেটা ভাবিই না। আমাদের বাড়ির ছোট সন্তানদের নিয়ে যাই প্রাণীদের সাথে পরিচিত করাতে, তাও আবার কোথায় বন্দি চিড়িয়াখানায়।
এই প্রক্রিয়ার বিনোদন থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে,সচেতন হতে হবে। কোনটা সুস্থ স্বাভাবিক বিনোদন সেটা বোঝার যথেষ্ট ক্ষমতা আমাদের রয়েছে। কারন এখন আর সেই যুগ নেই যে কেউ কিছু চাপিয়ে দিলেই তা আমরা মেনে নেবো। এটা সর্বাধুনিক যুগ, আর আধুনিক যুগ তো উনিশ আর বিশ শতক থেকেই চলে গেছে। এখন এই একবিংশ শতাব্দীর দুই দশক পার করা মানুষগুলো যদি এসে বলে, আমরা তো বুঝি না তাহলে সেটা মেনে নেয়া যায়। কারন আমরা সবাই তো সব কিছু বুঝবো না। কিন্তু নির্লজ্জের মতো যখন বলে আমরা জানি না- ওগুলো বর্বর ছাড়া আর কিছু না।
চিড়িয়াখানা বরাবরই নির্মম কারন পশুকে জোর করে আটকে রেখে তাদেরকে বিনোদনের উপজীব্য বানানোকে সংরক্ষণ আর গবেষণা বলে না! কারন চিড়িয়া ঘরের সাইজ এবং সেসকল স্থানের প্রাকৃতিক স্বয়ংসম্পূর্নতা দেখলেই বোঝা যায় কি হচ্ছে ভেতরে আর সেটার উদ্দেশ্যই বা কি! বন্যপ্রানীদের প্রতি মায়া কতৃপক্ষের না থাকতে পারে, কিন্তু সংরক্ষণ আর রিসার্চ করার উদ্দেশ্য যদি থেকেই থাকে সেগুলো বনের পাশে কি হতে পারে না? কেন, এখন তো অনেক দেশেই এমন বন কেন্দ্রিক সংরক্ষণাগার আর গবেষণা কেন্দ্র আছে যারা বনেই তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে এবং কাজ শেষ হলে প্রাণীদের অবমুক্ত করে দেয়। এমন তো নয় যে আমাদের প্রাণীদের এক দুই হাত কাছ থেকেই দেখতে হবে, আমরা তাদের আবাসস্থলে না গিয়েও তাদের বিভিন্ন সংরক্ষণ কেন্দ্রে অবমুক্ত অবস্থায় দেখতে পারি। এতগুলো এনিমেল চ্যানেলে কি হয় না আমাদের ?
কখনোই চিড়িয়াখানা ভ্রমণ সুস্থ্য স্বাভাবিক বিনোদন হতে পারে না, একজন সচেতন মানুষ এই বিকৃত নির্মম বিনোদন উপভোগ করতে কি করে যেতে পারে? প্রকৃতির মধ্যে বাস করে অন্যান্য প্রজাতির প্রাণীদের আটকে রাখাটা ঘোরতর অন্যায় কাজ। আমরা মানুষরা প্রাচীনকাল থেকেই অবিবেচক হয়ে হাজারটা না লাখ লাখ জলজ এবং স্থলে বাস করা প্রাণীর গলায় দড়ি পরিয়েছি, প্রত্যেকটাই মানুষের নিজেদের নিজস্ব খায়েশ মেটানোর জন্য। তার মধ্যে কিছু তারা লালন পালন করে ভক্ষণ করে, কিছু আর্থিক কাজে লাগান আর কিছু বিনোদনের ব্যবসায় কাজে লাগান। পশু পাখি আর জলের জলজ প্রাণী এদের উপর অত্যাচার বন্ধ করার এখনই সময়, এমনিতেও অনেক দেরি হয়ে গেছে মানুষ!
আজকে কোনো কোনো দেশ কুকুর, বিড়াল, ইঁদুর, বাদুড়, ব্যাঙ, প্যাঙ্গলিন, গরু, ছাগল, পাখি, ডলফিন, হাঙর, কচ্ছপ- কিছুই বাদ দিচ্ছে না, সব খেয়ে ফেলেন উনারা! একবার নয়, এই বন্য প্রাণী ভক্ষণের এবং বন্য প্রাণী জোর করে সংরক্ষণ এর কারনে ২০০ বছর ধরে একটানা প্রাণী বাহিত সংক্রামক রোগে কোটি কোটি মানুষ মারা যাচ্ছে, এটা কি অস্বীকার করা যাবে? খেয়াল করলেই সব কিছু পরিস্কার হয়। এখন এটা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা যে প্রাণীদের তাদের নিজের জায়গায় ফিরিয়ে দিতে হবে, তাদের বাসস্থান এর কোন ক্ষতিসাধন করা যাবে না। খাদ্যভ্যাসটা একদিনে বদলাবে না তবে অস্তে আস্তে চেষ্টা করলে হবে।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন