এগিয়ে চলো এক্সক্লুসিভ

মিউজিক এন্ড টেরর- রত্নম ও রহমানের ভালোবাসার দর্শন! (পর্ব ৩)

3 / 4

মিউজিক এন্ড টেরর- রত্নম ও রহমানের ভালোবাসার দর্শন! (পর্ব ৩)

মিউজিক এন্ড টেরর- রত্নম ও রহমানের ভালোবাসার দর্শন!  (পর্ব ৩)
  • পড়তে সময় লাগবে মিনিট
  • পড়তে সময় লাগবে মিনিট

বার্কলি কলেজ অফ মিউজিকের মঞ্চে দাঁড়ানো এ আর রহমান, একটু আগেই এই কলেজে সঙ্গীত নিয়ে পড়াশুনা করতে আসা ছেলেমেয়েরা ‘দিল সে’ সিনেমা থেকে তার জিয়া জালে গানটা পরিবেশন করলো। দর্শকসারিতে মুহুর্মুহু হাততালি, এ আর রহমানের হাতে বার্কলির অনারারি ডিগ্রী। সে মুহূর্তে এ আর রহমান কল্পনায় চলে গিয়েছিলেন বোধহয় আরও বিশ বছর আগে। তার বাড়ির পেছনে তার গড়া স্টুডিওতে তিনি বসে আছেন। হাতে বার্কলি কলেজ অফ মিউজিকের এডমিশন লেটার আর সামনে বসে আছেন মণি রত্নম ও সন্তোষ শিভান। তারা এসেছেন তাদের ‘রোজা’ সিনেমার মিউজিক ডিরেকশনের জন্য তাকে এপ্রোচ করতে। এতোদিন বিভিন্ন প্রোডাক্টের এডের জন্য জিঙ্গেল বানাতেন রহমান, ইল্যায়ারাজাসহ অনেক মিউজিক ডিরেক্টরের সাথে কাজ করেছেন বটে কিন্তু এখনো নিজের পায়ে দাঁড়াবার মতো শক্তি হয়েছে বলে মনে করেন না। কিন্তু মণি রত্নম মনে করেন যে রোজার জন্য তিনিই পারফেক্ট।

অবশ্য মণি রত্নম এসেছিলেন স্টুডিওতে তার কিছু টিউন শোনার জন্য। এ আর রহমান কাভেরী নদীর বিরোধ নিরসনে একটি টিউন কম্পোজ করেছিলেন অনেক আগে সেটিই শোনালেন মণি রত্নমকে (পরে গিয়ে এই সুরে তামিজাহ তামিজাহ, হিন্দিতে ভারত হামকো জান সে পায়ারা হ্যা গান রচিত হয়)। সে টিউন শোনার পর ২৫ হাজার টাকার চেক সাইন করে এই সিনেমায় চুক্তিবদ্ধ করতে চান তাকে মণি রত্নম। অথচ সেসময় ২৫ হাজার টাকা এডের জিঙ্গেল বানিয়ে ৩ দিনেই কামাই করতে পারতেন রহমান। কিন্তু তবুও মণি রত্নমের অনুরোধ গ্রহণ করেন তিনি, মণি রত্নমের সিনেমার সঙ্গীতময়তাই হয়তো আকৃষ্ট করেছিল রহমানকে। বার্কলি কলেজের চিঠি পড়ে থাকলো আস্তাকুড়ে, যে স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে সঙ্গীতের জগতে পা রাখলেন রহমান সে স্বপ্ন পূরণ হল বিশ পছর পরে বার্কলি কলেজের পক্ষ থেকে তার সঙ্গীতের জন্য সম্মাননাসূচক ডিগ্রী পেয়ে। হয়তো সেদিন বোস্টনের বার্কলি কলেজে চলে গেলে রহমানের এই ইতিহাস আর লেখা হতো না। রোজা, বম্বে ও দিল সে এই তিন সিনেমার কালজয়ী সঙ্গীত নিয়ে প্রায় তিরিশ বছর পর করোনা লকডাউনে কেউ লিখতো না। যে মিউজিক বদলে দিয়েছিল ইন্ডিয়ান মিউজিককেই, যে মিউজিক আজ থেকে শতবছর পরেও কোন সাইবর্গের কানে নতুনত্বের স্বাদ দেবে, চলুন সে মিউজিকে ডুব লাগাই।

মণি রত্নম রহমানের অনবদ্য মিউজিক পেয়ে তার সিনেমায় প্লেস করতে বেশ হিমশিম খেয়েছেন। কখনো রত্নম আর রহমানের জুটি মিউজিক্যাল ব্রিলিয়ান্স তৈরি করেছে স্ক্রিনে যা কেউ আজ অব্দি ছুঁতেও পারে নি আবার কখনো রহমানের মিউজিক ছাপিয়ে গিয়েছে রত্নম আর শিভানের ভিশনকে। শুরু থেকেই শুরু করা যাক। রোজা, বম্বে ও দিল সে- প্রতিটি সিনেমার শুরুতেই রহমান সিনেমার টোন ঠিক করে দিয়েছেন। রোজা শুরু হতেই আমরা শুনতে পাই ভারী জীপের আওয়াজ, পাতার খসখস, পাখির কিচিরমিচির যা প্রতিধ্বনিত হয়ে দর্শকের কল্পনায় একটি ভয়ার্ত কিন্তু সবুজ নৈসর্গিক জনপদের ছবি আঁকে, তারপরই শোনা যায় আযানের ধ্বনি। রহমান যেন কাশ্মীরকেই প্রকাশ করলেন সঙ্গীত দিয়ে। বম্বের শুরুতেও প্রথমে খুব রোম্যান্টিক একটা মেলোডি শুনতে পাবে দর্শক। মনে হবে যেন নিটোল প্রেমের গল্প এই সিনেমায় কিন্তু তারপরই ভয়াবহ এক আর্তচিৎকার। সিনেমার গল্প পুরোটাই যেন বলে দেয় রহমানের অনবদ্য ইন্ট্রো।

এ আর রহমান ও মণি রত্নম

দিল সে তেও তাই। বাচ্চার কান্না, গুলির শব্দ, বাতাসের শো শো, আগুনে পোড়ার আওয়াজ, পাখির কিচিরমিচির সবই যেন নির্দেশ করে যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি অঞ্চলের কথা যেখানে হিম শীতল বাতাস, রহমান যেন মিউজিক দিয়েই আমাদের নিয়ে চলেন শীতল অথচ ভয়ঙ্কর উত্তরপূর্ব ভারতে। প্রথম শটেই কাঁটাতারের বেড়া কেবল নিশ্চয়তা দেয় দর্শককে যে যুদ্ধবিধ্বস্ত এক সীমান্তবর্তী এলাকার দুঃখ বয়ান করা হবে এখানে। রহমান এই তিনটি সিনেমাতেই শুরুর পনের মিনিটের ভেতর একটি করে গান রেখেছেন। মূল চরিত্রের ক্যারেক্টার আর্ক বর্ণনা করা হয়েছে প্রতিটি গান দিয়ে। সেটা রোজা সিনেমায় ‘চিন্না চিন্না আসাই’/ছোটি সি আশা হোক, বম্বের কান্নালানে/কেহনা হি কেয়া হোক অথবা দিল সে’র থাইয়া থাইয়া/ছাইয়া ছাইয়া। রোজা, শেখর-শায়লা বানু ও অমরকে চেনা হয়ে যায় এই তিন গানের মধ্য দিয়ে। সবচেয়ে দারুণ ব্যাপার হল লিরিকের ক্ষেত্রে মূল গানের লিরিকের অর্থের সাথে মিলিয়েই লিরিক লেখা হয়েছে প্রতিটি সিনেমায়। রোজা ও বম্বের গীতিকার ছিলেন ভাইরামুথু ও দিল সে সিনেমাত গীতিকার ছিলেন গুলজার (যে ভাষায় নির্মিত হয়েছে মূল সিনেমা সে ভাষার গীতিকারের নাম দেয়া হয়েছে)।

ছোটি সি আশা গানে গীতিকার ভাইরামুথু ১৬টি ইচ্ছের কথা সন্নিবেশ করেছেন, এই গানটি রহমানেরও কম্পোজ করা প্রথম গান ছিল। রুকমানি গানে গীতিকার সহবাস উদযাপনকে পুঁজি করে গ্রামীণ সংস্কৃতির বিভিন্ন হাস্যরস তুলে ধরেছেন, রহমানও এই গানে র’ ফিল আনার জন্য ‘থাম্পিং ফিট’ এর সাউন্ড ব্যবহার করেছেন। পরে পপ কালচারে অনেকেই সে সাউন্ডটি গ্রহণ করে। কাধাল রোজাভে/রোজা জানেমান গানের জন্য রহমান ‘কাপি রাগ’ ব্যবহার করতে চাইলেন। কর্ণাটক মিউজিকে এই রাগ দিয়ে মূলত বিরহ, নিবেদন প্রকাশ করা হয়। রহমান এই রাগকে সঙ্গী করে অপহৃত ঋষি কুমারের গলায় রোজার জন্য নিবেদন প্রকাশ করলেন। গানটির হিন্দি ভার্শন নিয়ে তিনি তখনকার সময়ের জনপ্রিয় শিল্পী কুমার শানু, অলকা ইয়াগনিকের কাছে গেলেও রহমান নতুন কম্পোজার হওয়ায় তাকে ফিরিয়ে দেন তারা। তামিল ভার্শনে তখন প্রতিষ্ঠিত গায়ক এস বি বালাসুব্রামানিয়াম কণ্ঠ দিলেও হিন্দির জন্য তিনি বালাসুব্রামানিয়ামের পাশাপাশি গজল শিল্পী হরিহরণকে দিয়েও গানটি গাওয়ান। হরিহরণকে তারপর থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয় নি। ইয়ে হাসিন ওয়াদিয়া, ভারত হামকো জান সে পেয়ারা হ্যা গানগুলোও প্রচুর জনপ্রিয়তা পেয়েছিল তখন। রোজার ক্যাসেট সেসময় সব ভাষা মিলিয়ে প্রায় ৩০ লাখ কপি বিক্রি হয়েছিল, যার বর্তমান বাজারমূল্য ধরলে প্রায় ৪৬ কোটি রূপি। এছাড়া এ আর রহমানকেও চিনেছিল পুরো দেশ। এরকম সাউন্ড, এরকম মিউজিক এর আগে কেউ শোনে নি কখনো।

বম্বে সিনেমার শুরুতেও এ আর রহমান ক্যারেক্টার ডিফাইনিং গান রেখেছেন। শেখরের আকর্ষণ ও শায়লা বানুর ভয়ের মিশেলে কান্নালানে/কেহনা হি কেয়া গান রচনা করেন এ আর রহমান। এই গানে রহমান প্রথম কাওয়ালি মিউজিকে রোম্যান্টিক ট্রিটমেন্ট ইউজ করেছেন। সেসময় রোম্যান্টিক টিউনের আলাদা চাহিদা ছিল, কিন্তু রহমান কাওয়ালি টিউন নিয়ে সেটার ওপর কে এস চিত্রার ভয়েসে রোম্যান্টিক একটা ফ্লেভার আনেন। গানের মাঝখানে যখন কাওয়ালরা সুর দেয় তখনই যেন মনে হয় দুই ধর্মের মতো দুই সুরেরও মিল হচ্ছে সেখানে। এই সুর রহমান প্রতিটি রোম্যান্টিক এনকাউন্টারে ব্যবহার করেছেন পুরো সিনেমাজুড়ে। সবকিছুর জন্যই যেন রহমানের একটা থিম মিউজিক ছিল। সেসময় এরকম থিম মিউজিকের কন্সেপ্ট কেউ ভাবতেও পারে নি ইন্ডিয়ায়। রোম্যান্টিক সিনের জন্য থিম ছিল, ক্যারেক্টারের জন্য থিম ছিল এমনকি ক্লাইম্যাক্সের জন্য থিম পুরো সিনেমাজুড়েই গড়ে গড়ে নিয়ে এসেছেন যেন রহমান। শুরুর সে চিৎকার, সে আর্তনাদ হিন্দু-মুসলমানের রেষারেষির সময় বারবার ব্যবহার করেছেন রহমান।

দুই মাস্টার মেকার এক ফ্রেমে

বম্বে সিনেমার সবচেয়ে জনপ্রিয় গান উয়িরে/তু হি রে, এই গানের জন্য এ আর রহমান সুব্রামানিয়াম, ইয়াসুদাস ও হরিহরন তিনজনকেই ভেবেছিলেন। হিন্দি তু হি রে পরে হরিহরনকে দিয়েই গাওয়ান রহমান। এই গানের মিউজিকে রহমানের সুফি প্রভাব লক্ষণীয় ছিল। কে এস চিত্রা ও কবিতা কৃষ্ণমূর্তি এই গানে তাদের অসাধারণ গায়কীর ছাপ রেখেছিলেন। রোজা সিনেমার গ্রামীণ রুকমানি গান বম্বেতে ঠিক মানায় না তাই বম্বেতে আসার পর শেখর ও শায়লার সহবাসকে রহমান উদযাপন করলেন হাম্মা হাম্মা গান দিয়ে। এই প্রথম রহমান র‍্যাপ ব্যবহার করলেন তার গানে, ফাস্ট বিটের এই গানটি যেমন বম্বের আধুনিকতার প্রকাশ ছিল তেমনি মিউজিকের আধুনিকতায়ও অদ্বিতীয় এই গানটি। মুক্তির প্রায় ২৫ বছর পর এখনো এই গানের বিট বা রিদম একটুও স্লো মনে হবে না শ্রোতার কাছে। এতোটাই এগিয়ে ছিলেন রহমান সময়ের চেয়ে।

রোজা ও বম্বের তুলনায় দিল সে এতো ব্রড অডিয়েন্সের কাছে পৌঁছাতে পারেনি বিভিন্ন কারণে। সে সময় দিল সে’র মিউজিক রোজা ও বম্বের মতো জনপ্রিয় হয়নি। মণি রত্নম ও এ আর রহমান উত্তর ভারতে বা হিন্দি স্পিকিং অডিয়েন্সদের জন্য একেবারেই নতুন। আর দিল সে’র কন্সেপ্ট রোজা ও বম্বের তুলনায় আরও আনকোরা ছিল। কিন্তু সে আনকোরা সাবজেক্ট, হিন্দি ভাষায় এ আর রহমান ও গুলজারের প্রথম কোলাবরেশন দিল সে’কে পরিণত করেছে কাল্ট ক্লাসিকে। মণি রত্নমের খুব পার্সোনাল এই সিনেমার মিউজিক ও ফিলসফি নিয়ে তাই আলাদা পর্বই রাখতে হচ্ছে। সে পর্বেই শেষ হবে মণি রত্নম ও এ আর রহমানের এই অনবদ্য ট্রিলোজির কথকতা।

চলবে...

শেয়ারঃ


মিউজিক এন্ড টেরর- রত্নম ও রহমানের ভালোবাসার দর্শন!