এগিয়ে চলো এক্সক্লুসিভ

মিউজিক এন্ড টেরর- রত্নম ও রহমানের ভালোবাসার দর্শন! (পর্ব ৪)

4 / 4

মিউজিক এন্ড টেরর- রত্নম ও রহমানের ভালোবাসার দর্শন! (পর্ব ৪)

মিউজিক এন্ড টেরর- রত্নম ও রহমানের ভালোবাসার দর্শন!  (পর্ব ৪)
  • পড়তে সময় লাগবে মিনিট
  • পড়তে সময় লাগবে মিনিট

রোজা ও বম্বের মিউজিকের আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার পর মণি রত্নম তার প্রথম হিন্দি ফিচার ফিল্ম দিল সে’র জন্যও রহমানকেই সঙ্গীতায়োজন করার দায়িত্ব দেন। রহমানের সাথে এবার গীতিকার হিসেবে যুক্ত হন গুলজার, আর সৃষ্টি হয় এক অনবদ্য মিউজিক অ্যালবামের। এই সিনেমার জন্য মণি রত্নমের অনুপ্রেরণা ছিল প্রাচীন আরবি সাহিত্য ও বুল্লে শাহ্‌র গান। বুল্লে শাহ্‌র থাইয়া থাইয়া থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই গুলজার লিখে ফেলেন ছাইয়া ছাইয়া গানের লিরিক।

গুলফোশ কাভি ইতরায়ে কাহি, মেহকে তো নাজার আ যায়ে কাহি,

তাভিজ বানাকে পেহনু উসে, আয়াত কি তারাহ মিল যায়ে কাহি,

ও ইয়ার হে জো ঈমান কি তারাহ, মেরা নাগমা ওহি মেরা কালমা ওহি।

ইয়ার মিসালে ও’স চালে, পাও কে তালে ফেরদাউস চালে,

কাভি ডাল ডাল, কাভি পাত পাত, মে হাওয়াপে ঢুন্ডু উসকি নিশান।

সুখবিন্দরের কণ্ঠে অমর যেন নিজের ভবিতব্যই গাইছিল। ফুল তার সৌন্দর্যের গর্ব দেখাবেই, ঘ্রাণ পেলে ঠিকই তাকে দেখা যাবে। সে ঘ্রাণকে তাবিজ করে পরে নিলে গলায় পাক আয়াতের মতোই তাকে ঘিরে রাখবে সে। আমার প্রেয়সীর ওপরই আমি ঈমান এনেছি, আমার ফরিয়াদি গানও সে, আমার ঈমানি কলেমাও সে। আমার প্রেয়সী চলে ঘাসে শিশিরের মতন, যার পায়ের নীচে জান্নাতুল ফেরদৌস পাওয়া যায়। আমি শিকারি পাখি হয়ে তাকে খুঁজে বেড়াবো প্রতিটি ডালে, প্রতিটি পাতায় পাতায়। অমর সেভাবেই খুঁজেছে মেঘনাকে, সেভাবেই মেঘনার ওপর ঈমান এনেছে, মেঘনার ইবাদত করেছে। কিন্তু বিনিময়ে স্বর্গ খুঁজে পায় নি বরং মৃত্যুকে আপন করে নিয়েছে। মণি রত্নম ঠিক করেছিলেন ট্রেনে করে শাহরুখ যাবে তার উদ্দেশ্যে আর পেছনে ফকিররা এই গান ধরবে। কিন্তু গান শুনে শাহরুখের মনে হয়েছিল যে এই গানে নাচতে হবে তার নিজের, তাই পরিচালককে কনভিন্স করে ড্যান্স নম্বর বানিয়ে ফেলেছিল। সিনেমার সবচেয়ে হিট গানও হয়তো সেজন্যই হয়েছিল।

জিয়া জালে আর দিল সে রে দুটো গানেই মণি রত্নম ক্যারেক্টারের ইমাজিনেশন দেখিয়েছেন। জিয়া জালে গানে প্রীতির কল্পনায় আমরা তার ওয়াইল্ড ফ্যান্টাসির দেখা পাই। এ আর রহমান লতা মুঙ্গেশকরের কণ্ঠে প্রীতির সেক্সুয়াল ফ্যান্টাসিকে অনবদ্যভাবে প্রকাশ করেন। ওদিকে দিল সে রে গানে আমরা উত্তরপূর্ব ভারতের ইন্সার্জেন্সির স্বরূপ ও সেখানেও যে ভালোবাসা জন্ম নিতে পারে সেটাই যেন অমরের কল্পনায় দেখান পরিচালক। অমরের কল্পনায় সে ও মেঘনা গাছের পাতার মতো, যারা ঝরে পড়ে গেছে কিন্তু আবার ভালোবেসে তারা ফুটতে চায়।

দো পাত্তে পাতঝার কে, পেরো সে উতরে থে, পেরো কি শাখো সে উতরে থে।

ফির উতনে মউসাম গুজরে, ও পাত্তে দো বেচারে, ফির উগনে কি চাহাত মে,

ও সেহরাও সে গুজরে, ও পাত্তে দিল দিল দিল থে।

সর্বজ্ঞ দৃষ্টিকোণ থেকে অমর যেন বলতে থাকে তার ভালোবাসার কথা। তাদের সম্পর্কের মাঝেও কাঁটাতারের বেড়া আছে, পাথরের দরজা দেয়াল আছে, সেখানে শ্যাওলাও যেমন পড়ে তেমনি ফুলও ফোটে। এভাবেই গল্প চলতে থাকে, চলতেই থাকে।

অ্যায় আজনাবি গানটি রহমান যেন অমরের পক্ষ থেকে মেঘনাকে শোনানোর জন্যই বানিয়েছেন। রেডিওতে মেঘনা শুনতে পেয়েও তাই বন্ধ করে দেয়। কারণ সে চাইলেও সাড়া দিতে পারবে না। যে পাখি বিদেশ থেকে এসেছে তাকে সে ঘরে আনতে পারবে না। তাই গান আসার আগেই আমরা অনেক সিনেই ব্যাকগ্রাউন্ডে আসামিজ ভাষায় শুনতে পাই- পক্ষী পক্ষী বিদেশি। পরে মূল গানে পাখি পাখি পারদেসি ঠিকই বাজতে থাকে। অমরের মনও গেয়ে ওঠে-

অ্যায় আজনাবি, তু ভি কাভি আওয়াজ দে কাহি সে

ম্যা ইয়াহা টুকরো পে জি রাহা হু, তু কাহি টুকরো মে জি রাহি হ্যা।

ঠিকমতো নাম ঠিকানা না জানা মেঘনাকে খুঁজছে অমর, সাড়া দিতে বলছে। সেও যেমন দূরে থেকে পরিবারের সাথে হোক, কাজের সাফল্যে হোক টুকরো টুকরো জীবন যাপন করছে, পূর্ণতা নিয়ে যাপন করতে পারছে না সেরকম তো সেও নিশ্চয়ই অপূর্ণ জীবন যাপন করছে। কিন্তু মেঘনা কখনোই সাড়া দেয় নি অমরের সে ডাকে। কারণ সে শুরু থেকেই জানতো যে এই অপূর্ণ জীবনই তার নিয়তি।

দিল সে সিনেমার সবচেয়ে আন্ডাররেটেড ও একইসাথে সবচেয়ে অনবদ্য গান ‘সাতরাঙ্গি রে’। এই গানের লিরিক, মিউজিক। ভিজুয়ালাইজেশন, কোরিওগ্রাফি প্রতিটি এসপেক্ট একে অপরকে কমপ্লিমেন্ট করে। এই গান গাইবার জন্য রহমান সনু নিগম ও কবিতা কৃষ্ণমুর্তিকে ডাকেন। এই গানে মণি রত্নম চেয়েছিলেন তিনি ভালোবাসার যে ৭টি স্তর নিয়ে এই সিনেমা বানাতে চেয়েছেন সেটিকে এক গানে নিয়ে আসার জন্য। গুলজার অনবদ্য লিরিকে সাত রঙের সাথে ভালোবাসার সাত স্তরকে মিশিয়ে অসাধারণ গীতিকবিতা রচনা করলেন। আর মিউজিকের রহমান এরাবিক টিউন ইউজ করলেন সাথে গালিবের পোয়েট্রি। রোমান্স পর্বে যে ৭টি স্তরের কথা আলোচনা করেছিলাম এই গানেও সে ৭টি স্তরের দেখা পাওয়া যায়। সাথে সাতরঙে সে ভালোবাসার পরিবর্তনও দেখা যায়।

https://3.bp.blogspot.com/-3jshllajh10/W0rzQlf-bvI/AAAAAAAANWs/cC0L_If11-UlzHz5bXdTLJbeOr6LWcZWgCLcBGAs/s640/SAT.jpg
দিল সে সিনেমার সবচেয়ে আন্ডাররেটেড এবং অনবদ্য গান হচ্ছে সাতরাঙ্গি রে

 

হাব্

দিল কা সায়া হামসায়া সাতরাঙ্গি রে, মানরাঙ্গি রে

কোয়ি নূর হে তু, কিউ দূর হে তু, যাব পাস হে তু এহসাস হে তু,

কই খোয়াব হে ইয়া পারছায়ি হে সাতরাঙ্গি রে।

গানের শুরুতেই আমরা দুজনকে কালো পোশাকে দেখি। মেঘনা এখানে আরাধ্য, আর অমর আরাধনা করে। সে গেয়ে ওঠে যে তার ছায়া সাত রঙের। সে ছায়ার রঙ কালোতেই দেখতে পাই আমরা মেঘনাকে। যার কাছে আসলে তাকে ছায়ার মতো লাগে আর দূরে গেলে লাগে নূরের মতো। সে নূরের রঙ শাদাতে মেঘনাকে দেখা যায় এর পরে, কিন্তু অমর তখনো কালো পোশাকে। কারণ সে নূরের হাবে মত্ত, সে নূর তাকে দূর থেকে হ্রদের ওপারে আকর্ষণ করে হাতছানি দিচ্ছে গালিবের কবিতা পড়ে।

উন্স

আঙ্খো নে কুছ এয়সা ছুয়া, হালকা হালকা উন্স হুয়া দিল কো মেহসুস হুয়া।

তু হি তু তু হি তু জিনে কি সারি খুশবো, তু হি তু আরজু আরজু।

মেঘনার চোখ দেখেই হয়তো মায়া/উন্সে মত্ত হয়েছিল অমরের মন। তাই এখন মেঘনাই তার কাম্য, সে চোখের ভাষা সে পড়তে চায়। মেঘনা এবার রঙ বদলে আসলো কমলা রঙে। অমর তখনো কালোতে।

ইশক

তেরে জিসম কি আঁচ কো ছুঁতে হি মেরে সাস সুলাঘনে লাগতে হে,

মুঝে ইশক দিলাসে দেতা হে, মেরা দার্দ পিঘালনে লাগতা হে।

এবার মেঘনা হলুদে, পেছনে আগুনের হলুদাভ শিখা। অমর বলছে তোমার শরীরে হাত বুলাতে গেলেই মনে হয় তোমার শরীরের আঁচে আমার নিঃশ্বাস এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। তখন ভালোবাসা এসে আমাকে বোঝায় আর আমার কষ্ট দূর হয়ে যায়। অমর যে প্রেমে মত্ত, ইশকে ডুবে যাচ্ছে সেটাই যেন দেখানো হয়।

আকিদাত

তু হি তু, জিনে কি সারি খুশবু, তু হি তু, আরজু আরজু।

সবুজে এবার মেঘনা। অমর কালোতেই। অমর গেয়ে ওঠে যে ভালোবাসা তো বটেই সে এখন তার আরজুও। তার প্রতি সে বিশ্বাস স্থাপন করে ফেলেছে। আকিদাত স্তর পার করে ফেলেছে সে।

ইবাদত

মে ফার্শ পে সাজদে কারতা হু, কুছ হোশ মে কুছ বেহোশি সে

অমর এখন মেঘনার প্রতি তার ভালোবাসার জন্য ইবাদত করতে চায়। সে মাটিতেই সেজদা দেয় তার জন্য, কখনো হুঁশ থাকে আবার কখনো থাকে না। ইবাদত করে সেজদায় দুজন যেন এক হয়ে যায়। আমরা লালের মাঝে দুজনকে একসাথে জড়িয়ে থাকতে দেখি। আবার মেঘনা যখন নীল পড়ে তখন জলের মাঝে জলকেলি করতে দেখি দুজনকে।

তেরি রাহো মে উলঝা উলঝা, তেরি বাহো মে উলঝা উলঝা

সুলঝানে দে হোশ মুঝে, তেরি চাহো মে উলঝা হু।

দড়িসদৃশ পোশাক পরা মেঘনার পাশে দড়ির জালে আটকে থাকতে দেখা যায় অমরকে। সে আকুতি জানায় যে ভালোবাসার রাস্তায় এসে সে এলোমেলো হয়ে গেছে, তার কাছে এসে সে এলোমেলো হয়ে গেছে। তাকে হুঁশ ফিরে পেতে হবে নাহলে সে মেঘনার চাওয়াতে এলেমেলো হয়ে যাবে। দিনশেষে সিনেমাতেও তাই হয়। মেঘনার চাওয়ার মাঝে অমর নিজের সবকিছু হারিয়ে ফেলে, তার নিজস্ব সবকিছু এলেমেলো হয়ে যায়। অমর এখন আর নিজের হুঁশে নেই, তার মাথায় যেন জুনুন চেপে যায় ভালোবাসার।

জুনুন

মেরা জিনা জুনুন, মেরা মারনা জুনুন, আব ইসকে সিভা নেহি কোয়ি সুকুন।

অমর টের পেয়ে গেছে সে বেঁচে থাকলে এই ভালোবাসার কারণেই পাগলপ্রায় হয়ে থাকবে, মরলেও এর কারণেই মরবে। তাই সে যেন পাগলের মতোই বিলাপ করতে থাকে ধুলোর মাঝে। পাশে দিয়ে বেগুনি পোশাকে মেঘনা নিজেতে মত্ত যেন। এবার মৃত্যু ছাড়া আর কোন উপায় নেই।

মউত

মুঝে মউত কি গোদ মে সোনে দে, তেরি রুহ মে জিসম ডূবোনে দে।

শেষমেশ দুজনে শুভ্র শাদা পোশাকে, যেন কাফনের কাপড় পরে আছে মৃত্যু নিশ্চিত জেনে। অমর টের পেয়ে যায় যে তার ভালোবাসার পূর্ণতা মৃত্যুর মাঝেই। তাই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে যায়, মেঘনার আত্মায় তার শরীর ডুবিয়ে দিতে চায়। আমরা দেখি মৃত অমরকে মেঘনা তার কোলে নিয়ে রেখেছে। মেঘনাই যেন অমরের মৃত্যুদূত। সিনেমা শেষেও ঠিক একইভাবে দুজন একে অপরের কোলে মৃত্যুবরণ করে।

ইশক পার জোর নেহি হে ইয়ে ও আতিশ গালিব। ভালোবাসার জোর-জবরদস্তি হয় না, এটা এমনই এক আগুন যা জ্বলে না সহজে, আর জ্বলে গেলে তাকে নেভানো দায়। সে আগুনেই আত্মাহুতি দেয় অমর ও মেঘনা। সে আগুনে আত্মাহুতি দেয় তাদের ভালোবাসাও।

গুলজার, এ আর রহমান, সন্তোষ শিভান, মণি রত্নম মিলে তাদের টেরোরিজম ট্রিলজি, রোমান্স ট্রিলজি ও মিউজিক্যাল ট্রিলোজির শেষটা টানলেন মৃত্যু ও ভালোবাসা দিয়েই। যে ট্রিলোজি সে সময়কার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে সার্বজনীন মাত্রা দিয়েছে। যে ট্রিলোজি ভালোবাসাকে নতুন ভাষা দিয়েছে। যে ট্রিলোজি এ আর রহমানের মিউজিক্যাল ব্রিলিয়ান্সকে চেখে দেখার সুযোগ দিয়েছে। আবার কোন এক ক্লান্ত রাতে যদি তু হি রে কিংবা সাতরাঙ্গি রে শোনার সময় নস্টালজিয়ায় ডুব লাগান, একপাক্ষিক ভালোবাসার কথা মনে করে আর্দ্র হন তখন হয়তো এই লেখার কথাও মনে পড়বে; না পড়লেও ক্ষতি নেই।

(সমাপ্ত)

শেয়ারঃ


মিউজিক এন্ড টেরর- রত্নম ও রহমানের ভালোবাসার দর্শন!