কখনো লাশের সাথে ঘুমিয়েছেন? তাও আবার অচেনা কোন লাশ, একা, একটা রুমে? সেই কথায় আসছি, কষ্ট করে পুরোটা পড়বেন। আশা করি এই যুদ্ধে নতুন কিছু জানতে পারবেন।
আমি আক্রান্ত হই গত ১৭ই মে। প্রথম দুইদিন বেশ জ্বর ছিল, সাথে হালকা কাশি। দ্রুত সরাসরি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে টেস্ট করালাম, রেজাল্ট পেলাম দুইদিন পর, পজিটিভ। মোটেই ভয় পাইনি, অফিসের কাজেও (বাসা থেকেই) কোন ব্যাঘাত ঘটেনি।
শুরু হলো কভিড-১৯ এর চিকিৎসা। বুকটা বেশ ভারী হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। আমি বড় ভাই (হাসান মিসবাহ) কে বললাম, "ও (করোনা ভাইরাস) আমার বুকের মধ্যে কী করছে, জানা দরকার। ফুসফুস তো আক্রান্ত, আরো কিছু করছে কিনা, ওর গতিবিধি জানা দরকার।" ভাইয়া ডক্টরের সাথে কথা বললেন, ডক্টর কিছু ওষুধ চেঞ্জ করে দিলেন।
আক্রান্ত হবার পর প্রথম ৭ দিন আমার জ্বর ছিল মাত্র দুইদিন, আর সাথে হালকা কাশি, বুকটা বেশ ভারী, বুকের ব্যাথাটা ক্রমশ বাড়ছিল, নিশ্বাস ছোট হয়ে আসছিলো, নামাজে একটা আয়াত পড়তে ৩-৪ বার দম নিতে হয়। বুঝতে পারছিলাম শরীরের গতি সুবিধার না, ডক্টর হসপিটালাইজ হতে বললেন।
রোজার ঈদের দিন, কোভিডের ৮ম দিন চলছে। শুনছিলাম ৭ম থেকে ১২তম দিন সবচেয়ে বড় যুদ্ধটা হয়, যে জিতবে সে দুনিয়ায় রবে। আমার তখন রীতিমত যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ভাইয়া সহ ছুটলাম ঢাকা মেডিকেলে। ঈদের দিন, Severe Covid Symptoms নিয়ে হসপিটালে ভর্তি হতে যাচ্ছি। আমার স্ত্রী আমার বাসায় ফোন দিয়ে চিৎকার করে কেঁদে কেঁদে বাবা-মার কাছে শুধু দোয়া চাচ্ছিলো, কিসের জন্য বলতেও পারছিল না, কারন আমার বাসায় তখনো কেউ জানে না। এমন অসুখ, চোখের সামনে মৃত্যু দেখেও শেষবারের মত স্ত্রী-সন্তানকে একবার বুকে নিতে পারিনি।
ঢাকা মেডিকেলে গিয়েই মনে হচ্ছিল, এখানে সব করোনা রোগী, আমি ভর্তি হলে তো এমনিতেই মারা যাবো। যাই হোক, ভর্তির আগে অক্সিজেন স্যাচুরেশন চেক করা হলো, ৯৬-৯৭, আমি ভাইয়াকে বললাম সব ঠিক আছে, বাসায় যাব, বলেই চলে এলাম বাসায়।
এবার শুরু হলো মূল যুদ্ধটা, সেদিন রাতে নতুন করে জ্বর এলো, ভীষণ জ্বর, ১০২+, টানা, মোটেই কমছে না। সকাল বেলায় হঠাৎ খেয়াল করলাম, আমি বিছানা থেকেই নামতে পারছি না, মাথা ঘুরছে, মাথার পেছনে চিনচিনে তীব্র ব্যাথা। নামতেই পড়ে গেলাম, অক্সিজেন স্যাচুরেশন ততক্ষণে নেমে গেছে ৮৩ তে। আমাকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করা হলো। ভর্তি হয়েই অক্সিজেন নিলাম দীর্ঘ সময় ধরে, একটু করে ভালো লাগা শুরু হলো।
বেশ কিছু টেস্ট দেয়া হলো, করলাম, টেস্টের রিপোর্ট এলো বেশ খারাপ। এক্স-রে সাদা হয়ে গেছে, ফেরিটিন ৫৯৯ (নরমাল ৩০০)। শুরু হলো ইঞ্জেকশন, দিনে ৪টা। আশপাশের বেডে অধিকাংশ পেশেন্ট কাতরাচ্ছে, শ্বাস নিতে পারছে না। সন্ধ্যার পর একজন মারা গেল। একটু ঘুমাচ্ছিলাম। উঠে দেখি আরও একটা লাশ। নিশ্চয়ই ব্যাখ্যা দেয়ার প্রয়োজন নেই আমার তখনকার মানসিক অবস্থার।
আমার কিচ্ছু হবে না, সবাই বেশ সাহস দিচ্ছিলো, আমিও সেটাই মনে ধারণ করার চেষ্টা করছিলাম, মনোবল শক্ত রাখা খুব জরুরি। আলহামদুলিল্লাহ, আমার শরীর ইমপ্রুভ করতে শুরু করলো ধীরে ধীরে, মনে হচ্ছিল জিতে যাচ্ছি। ডক্টরকে বললাম আমার লাস্ট তিন দিন ধরে কোনো সিম্পটম নেই, বাসায় যাব। ছুটি পেলাম, যদিও পুরোপুরি সুস্থ না, কিন্ত মনে হচ্ছিল এখন বাসায় গিয়ে ঠিকমত খাবার দাবার খেলেই বাকিটা ঠিক হয়ে যাবে।
বাসায় এলাম, পিজি হাসপাতালের একজন নার্স বাসায় এসে ইঞ্জেকশন করে দিয়ে যায়। তিনদিন ভালোই গেলো। আমি তখনো পরিবার থেকে আলাদাই থাকছি।
বাসায় আসার ৪র্থ দিন, আর আমার আক্রান্ত হবার ১৬তম দিন চলছে। সেদিন সকাল থেকেই আজ আবার শরীরটা খারাপ লাগছে। ১১টার দিকে হঠাৎ মাথাটা চক্কর দিলো, অক্সিজেন চেক করলাম, ৭৭ এ নামছে, আল্লাহর অশেষ মেহেরবানী, তাই হয়তো এখনো বেঁচে আছি! ডক্টর দ্রুত হসপিটালাইজ হতে বললেন। আবার যাচ্ছি সেই মৃত্যুকূপে, আধঘণ্টার মধ্যে অক্সিজেন আবার ৭৫- এ নেমে আসলো, যাচ্ছি অনন্তের পথে, পেছনে গগন বিদীর্ণ করা কান্নার শব্দ ভেসে আসছে, এবার বুঝি আর ফেরা হবে না!
ঢাকা মেডিকেলে কেবিন খালি না পেয়ে এবার ভর্তি হলাম হলি ফ্যামিলি হসপিটালে যেখানে শুধু এনএসআই, আর্মি আর সাংবাদিকদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তবু এখানে চিকিৎসা পেতে বেশ বেগ পেতে হলো কারণ একটাই, ডক্টর আসতে চায় না, আমার কষ্ট শুনতে চায় না। তারা পাঁচদিনেও আমার জন্য একটি প্রেসক্রিপশন করে দিতে পারেনি, বাধ্য হয়ে আমি ঢাকা মেডিকেলের ট্রিটমেন্টই ফলো করছিলাম। তখন আমার ফেরিটিন আরও বৃদ্ধি পেয়ে ৯০০ তে উঠে গেছে।
এখানেও প্রথম দিনেই চোখের সামনে পাশের বেডে একজন পেশেন্ট টানা তিন ঘণ্টা মৃত্যুর সাথে লড়াই করে হেরে গেল। এত মৃত্যু, এত লাশ, আর নিতে পারছিলাম না। পাশেই লাশ, স্বজনরা আহাজারি করছে, আমি অক্সিজেন নিয়েই যাচ্ছি, কেমন করে ঘুমাই, বলুন!
এরপর এলো ৯ জুন, আলহামদুলিল্লাহ, আমার নতুন সব রিপোর্ট ভালো। তাই দেরি না করে বাসাতেই অক্সিজেনের ব্যবস্থা করে বাসায় এলাম। কোভিড টেস্টও দ্রুত করে ফেললাম, আলহামদুলিল্লাহ নেগেটিভ আসলো, পরপর ২ বার। সমস্ত শুকরিয়া মহান আল্লাহর দরবারে যার অশেষ মেহেরবানীতে এখনো বেঁচে আছি। বিশেষ কৃতজ্ঞতা এবং ভালোবাসা ড. মুরাদ স্যারের প্রতি যিনি এই পুরো সময়টা পাশে থেকে পরামর্শ এবং সাহস দিয়েছেন।
আমার ভাই (হাসান মিসবাহ) একরকম কোলে করে সব হসপিটালে নিয়ে আমার চিকিৎসা করিয়েছেন, অথচ ভাই আমার নিজেও আক্রান্ত ছিলেন। আমার স্ত্রীও আক্রান্ত ছিলো, তবুও আমার এতটুকু অবহেলা হতে দেয়নি। ভাবী, ছোট্ট দুটো ভাই তৌফিক, তাশরিফ অমানবিক কষ্ট করেছে, দিন রাত এক করে সেবা করেছে আমার, হাসপাতালে নিয়মিত ওষুধ, খাবার পৌছিয়ে দিয়েছে, আল্লাহ পাক ওদেরকে হেফাজত করুন।
এছাড়াও আরো অনেকেই অকৃত্রিম ভালোবাসা দিয়ে পাশে ছিলেন, ভালোবাসা সবার প্রতি। মঙ্গল তাদেরও হোক যারা মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরানো আপনজনের (!) একটা ইনজেকশন হসপিটালের গেটে দিয়ে আসতেও বাহানা খুজেছে।
তবে করোনামুক্তি হলেও, যন্ত্রণামুক্তি হয়নি সঙ্গে সঙ্গে। করোনা টেস্টের রিপোর্ট নেগেটিভ আসার পরও প্রায় মাস খানেক ভুগেছি অনিদ্রা, তীব্র এ্যাসিডিটি, স্মৃতিভ্রম ইত্যাদি সমস্যায়। শ্বাস নিতে এখনও মাঝে মাঝে কষ্ট হয়, এটা আতঙ্ক থেকেও হতে পারে। আমি এখন পর্যন্ত ৮৭টি ইনজেকশন নিয়েছি, ওষুধ খেয়েছি প্রায় ২২ ধরনের। কারো যে কোন পরামর্শ/সহযোগিতা লাগলে অবশ্যই জানাবেন, আমার সাধ্য অনুযায়ী চেষ্টা করব। আল্লাহ সবাইকে সুস্থ রাখুন।