আমার এখানে (ফ্রান্সে) লকডাউন শুরু হয়েছিল ১৩ মার্চ। বাইরে বের হইনি একদমই। ২২ মার্চ বাজার করতে বের হতে হয়েছিল পাশের গ্রোসেরি শপে। বাজার করতে বলার চেয়ে বাজার পিক করতে বলা ভালো। অনলাইনে অর্ডার করে ব্যাগগুলো আনতে বের হতে হয়েছিল ১৫ মিনিটের জন্য। আমার মত অনেকেই মাস্ক আর গ্লাভস পরে বের হলেও, অনেকের মধ্যে সেইরকম সচেতনতা দেখা যায়নি। গ্লাভস তো দূরে থাক, অনেককে দেখেছি মাস্কও পরা নেই।
বাজার নিয়ে বাসায় ফিরলাম। নির্দেশনা অনুযায়ী মাস্কটি একটা প্লাস্টিক ব্যাগে ভরে, ভালো মত মুখ আটকে নির্দিষ্ট স্থানে ফেলে দিয়ে আসলাম। পরনের পোশাক ওয়াশে দিয়ে, গোসল সেরে কাজে বসলাম।
তারপর কয়েকদিন পার হতেই অনুভব করলাম এলার্জির মত নাক-মুখ চুলকাচ্ছে, কিন্তু কোন জ্বর নেই। তারপর একে একে দেখা দেয়া শুরু করলো সিম্পটমস। শুরু হলো হঠাৎ গলা ব্যথা আর শুষ্ক কাশি দিয়ে। তারপর দেখি শরীর গরম। প্রথমে ভাবলাম আমি তো 'হট', তাই বোধ হয়! পরে বুঝলাম বিষয়টা হালকা জ্বর। সেই সাথে শুরু হলো নাক দিয়ে পানি ঝরা, নিজের নাককে নায়াগ্রা ফলস থেকে কোন অংশে কম মনে হচ্ছিলো না।
চোখ উঠে এমন লাল হলো যে অনায়াসে ড্রাকুলার মেয়ে ভার্সন বানালে কাস্ট পেয়ে যেতাম। তারপর হারালাম ঘ্রাণশক্তি। মানে পিজা, পাস্তা, কেক থেকে শুরু করে পারফিউমের দেশ ফ্রান্সের সবকিছুর ঘ্রাণ যেন গায়েব হয়ে গেছে। সাথে যুক্ত হলো পেটের সমস্যা। প্রকৃতি একটু পর পর এমনভাবে ডাকা শুরু করলো যে মনে হচ্ছিলো যে পেটের মধ্যে বহু মানুষের জমে থাকা কথাগুলাও বের হয়ে যাবে। ঘ্রাণশক্তি হারানোর এই একটা প্লাস পয়েন্ট ছিল অবশ্য, দুর্গন্ধ টের পাচ্ছিলাম না। সেই সাথে শরীর ব্যথা। আমার তখন সর্বাঙ্গে ব্যথা, ঔষধ দিবো কোথা টাইপ অবস্থা।
২৮ মার্চ ডাক্তারকে কল করলাম। তারা এসে টেস্ট করে জানালো যে আমি কোভিড-১৯ পজিটিভ। জীবনে সবসময় পজিটিভ নিউজ শুনতে চেয়েছিলাম। কিন্তু, এই পজিটিভ হবার নিউজ আমার দুনিয়া ঘুরিয়ে দিলো। বাংলা সিনেমায় খারাপ সংবাদ শোনার পর শাবানা আপা যেমন চিৎকার দিয়ে কান্না শুরু করলে বজ্রপাতের আওয়াজ দেখানো হতো, আমার সেরকমই মনে হলো। মনে হলো যেন চোখের সামনে বজ্রপাত হয়েছে। শাবানা আপার মত চিৎকার বা কান্নাকাটি না করলেও, ভয়ংকর প্যানিক অ্যাটাক হলো।
ডাক্তার বললেন, সকালে আর সন্ধ্যায় দিনে দুইবার শরীরের তাপমাত্রা চেক করতে। সেল্ফ মেডিকেশনের ব্যাপারে সাবধান করলেন, সোজা বাংলায় ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া পাকনামি করতে বারন করলেন। ঔষধ হিসেবে প্যারাসিটামল খেতে বললেন (তবে প্রতিবারে ১০০০ মিগ্রা এবং দিনে ৩০০০ মিগ্রা এর বেশি যাতে না হয়)। বলে গেলেন, এন্টিবায়োটিক এই ভাইরাসকে ঘায়েল করতে পারে না, তাই এন্টিবায়োটিক খেয়ে কাজ নেই। এন্টি-ইনফ্লেমেটরি ড্রাগস (যেমন, ibuprofen, Advil বা Aspirin) সেবন করতে শুধু নিষেধই করলেন না, বললেন এগুলো সেবনে অবস্থা আরো খারাপের দিকে যাবে।
আর বললেন বডি হাইড্রেটেড রাখতে মানে প্রচুর পরিমাণে পানি, স্যুপ ইত্যাদি খেতে। বললেন নিজেকে ঘরে আটকে রেখে বিশ্রাম করা আর পরিবার থেকে শারিরীক দূরত্ব বজায় রাখার উপর ঔষধ নাই। সেই সাথে ঘন ঘন হাত ধোয়া, ডিসপোজেবল টিস্যু দিয়ে নাক ঝাড়া, কন্টামিনেটিং সারফেস যেমন টয়লেট, থালা-বাসন, গ্লাস, ফ্লোর, বাথরুম ইত্যাদি জীবাণনাশক দিয়ে ডিজইনফেক্ট করা।
এই সময় প্যানিক করা স্বাভাবিক, কিন্তু যেভাবেই হোক মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। এনজাইটি বা মানসিক চাপ এই অসুখের সিম্পটমগুলোকে আরে বাজে দিকে প্রভাবিত করতে পারে।
ইতোমধ্যেই আমরা সবাই জেনে গেছি যে সাধারণত এই রোগ থেকে মুক্ত হতে দুই সপ্তাহ বা ১৪ দিন সময় লাগে। তবে সেটা সম্ভব হয় যদি বডির ইমিউন সিস্টেম ভালো থাকে। আমার ইমিউন সিস্টেম আগে থেকেই বেড়াছেড়া অবস্থা ছিল। আমার আগে থেকেই রক্তশূণ্যতা এবং হিমোগ্লোবিনের সমস্যা ছিল। যে কারণে এই ভাইরাস আমার শরীরে ১ মাস সংসার করতে পেরেছিল।
অনেকের ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে সিম্পটমগুলো শুরুতে ‘সীমিত আকারে’ দেখা দেয়, তারপর ২য় সপ্তাহ নাগাদ রোগির শারীরিক অবস্থা খারাপ দিকে যেতে থাকে বা নতুন নতুন সিম্পটম দেখা দিতে থাকে। তাই সীমিত আকারে সিম্পটম দেখা দেয়ার সময়ই ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিত, তাতে ভাইরাস শরীরে জেঁকে বসার সুযোগ পাবে না। আমার পক্ষে যেটা করা সম্ভব হয়ে উঠেনি। ফ্রান্সে আমি একা থাকি, দৈনন্দিন কাজে সহযোগিতা করার মতও কেউ ছিল না। তাই করোনা আমাকে শুরুতেই এমন কাবু করে ফেলেছিল যে রান্না করতে বিছানা থেকেই উঠতে কষ্ট হতো।
তিন সপ্তাহের মত ফ্রেঞ্চ সরকারের সরাসরি সহযোগিতা পেয়েছি। তারা বাসায় বাজার, রেডিমেড খাবার, মাস্ক ইত্যাদি দিয়ে যেত। মানসিক জোর বাড়াতে গ্রিটিং কার্ডও পাঠাতো। দুই দিন পর পর ডাক্তার বাসায় এসে দেখে যেতেন। তিন সপ্তাহের মত আমাকে আয়রন আর স্যালাইন পুশ করা লেগেছিল কারণ পেট খারাপ। যাই খেতাম পেটে থাকতো না, বের হয়ে যেত। তাছাড়া, ক্লোরোকুইনের মত এক্সপেরিমেন্টান্টাল ট্রিটমেন্টও চলছিল আমার উপর। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন যে, শরীর খুব বেশি খারাপ না হলে ক্লোরোকুইন দেয়া হয় না।
আমার শ্বাসকষ্ট শুরু হয় দুই সপ্তাহ পর। তারা আমার বাসাতেই অক্সিজেন পাঠিয়ে দেয়। অনেকেই ভাবতে পারেন, ফ্রান্সের মত উন্নত দেশে হাসপাতালে না নিয়ে বাসায় কেন? সত্যি বলতে করোনা ভাইরাস যে দেশেই ঢুকেছে তা সেটা উন্নত হোক বা অনুন্নত, সব দেশের চিকিৎসা ব্যাবস্থাকেই ঝাঁকি দিয়ে দিয়েছে। আমাকে হসপিটালে না নেবার কারণও সেটা। হাসপাতালে এত রোগী ছিল (এখনো আছে) যে নতুন রোগী ভর্তি করে সেবা দেয়া সম্ভব হচ্ছিলো না। আর আমি নিজেও যেতে চাইনি। কারণ, গেলে একটা বেডে পড়ে থাকতে হতো। বাসায় থেকেই ডাক্তারের পরামর্শ মত নিজের খেয়াল রাখতে থাকলাম। যখন খুব বেশি খারাপ লাগতো অক্সিজেন দিয়ে শুয়ে থাকতাম। রাতে জ্বর আসতো, তখন কতটা খারাপ লাগতো তা লিখে বোঝানো সম্ভব না।
নিজেকে বোঝাতাম, মনের জোর হারানো যাবে না, মেন্টালি দুর্বল হয়ে পড়লেই খবর আছে। তখন অসুখের কথা ভুলে থাকতে আঁকাআঁকি শুরু করলাম। মুখে অক্সিজেন লাগিয়ে বসে বসে ফেসবুকে আমার ফেভারিট কিছু মানুষের স্কেচ করা শুরু করলাম। ফটোল্যাব টাইপ এ্যাপ মার্কা জিনিস না কিন্তু, একদম কাগজে আঁকা পেন্সিল স্কেচ। এভাবে এঁকে আর স্কেচ পেয়ে মানুষের আনন্দ দেখে ভুলে থাকতাম যে আমার করোনা হয়েছে। আমার থেকে দূরে থাকা পরিবারের মানুষগুলো যাতে দুশ্চিন্তা না করে সে চেষ্টা করতাম। সেই সময় কল্পনায় চিন্তা করতাম, বিশাল এক যুদ্ধক্ষেত্র। কোটি কোটি ভয়ংকর করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে ফাইট করতেছি আমি। এই চিন্তাটা করার সময় আমি নিজেকে কেন যেন র্যাম্বোর মত কল্পনা করতাম। বেশ শক্তিশালী একটা ফিল পেতাম।
জুন মাসের ১ তারিখ ফাইনালি রিপোর্ট পেলাম আমি করোনা নেগেটিভ। শেষ কবে কোন ‘নেগেটিভ’ নিউজে এত খুশি হয়েছি মনে নাই। ভাবলাম সেলিব্রেট করা জরুরী। সুস্থতা সেলিব্রেট করলাম ১১ তারিখ, বাসার কাছের হাসপাতালে গিয়ে প্লাজমা ডোনেট করার মাধ্যমে। ফ্রান্সে ব্লাড ডোনারদের সবসময়ই যথেষ্ট খাতির যত্ন করা হয়, পারলে তো মাথায় তুলে রাখে। প্লাজমা ডোনেট করতে গিয়ে রীতিমত সেলিব্রিটি ট্রিটমেন্ট পেলাম। কি যে ভালো অনুভূতি হলো। তখনই ঠিক করে ফেললাম আবার প্লাজমা দেব এবং সেটা যতবার দেয়া সম্ভব হবে ততবার দেব।
খোঁজ নিয়ে জানলাম, একবার প্লাজমা ডোনেটের ২ থেকে ৮ সপ্তাহ পর আবার প্লাজমা দেয়া যাবে। আমি এখন ‘আবার প্লাজমা দেবার’ সবুজ সংকেতের অপেক্ষায় দিন গুনছি। গুনতে খারাপ লাগছে না, নতুন নতুন প্রেমে পড়লে শুরুতে প্রেমিকের সাথে দেখা করতে যেমন মন আকুপাকু ফিল করে প্রায় সেইরকম ফিল হচ্ছে...