আমার দৃশ্যমান কোন লক্ষণ ছিল না। তবে অফিস থেকে ফিরে ড্রেস পাল্টালে পায়ের নীচের দিকে চুলকাতো। দুইদিন সকালে ঘুম থেকে উঠার পর কাঁধে ব্যাথা হয়েছিল। আর ঠোঁটে জ্বরফোঁটা ছিল। এই অবস্থায় পরীক্ষা করিয়ে ৩ দিন পর পজিটিভ রিপোর্ট পেলাম।
আমি তখন অফিসে। হাতে অনেক কাজ। ৩/৪ থানার পুলিশ অপেক্ষা করছে। ফোন ধরার সময় নাই। এর মধ্যে ২/৩ টার দিকে একটা ফোন। হ্যালো বলার সাথে সাথে একটা বরফ শীতল কন্ঠ নাম জানতে চাইলো। বলার পর জানতে চাইলো কেন পরীক্ষা করিয়েছি? এরপর আরও শীতল কন্ঠে বলল "আপনার রেজাল্ট পজেটিভ। মন খারাপ করবেন না। আমি প্রেসক্রিপশন পাঠিয়ে দিচ্ছি। ওষুধগুলো খান আর নিয়ম মেনে চলুন।"
আমার পাশে তখন দুইজন এস আই। যাদের একজন করোনাকে জয় করেছে এবং অন্যজন অনেক করোনা রোগীর দেখভাল করেছে। ওরা আমাকে অনেক সাহস দিচ্ছিল। কিন্তু আমার চোখের সামনে শুধু আমার সন্তান সম্ভবা স্ত্রী আর ছোট্ট মেয়ের মুখ ভেসে উঠছে। কাকে বলব। কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। একটা ভাই ঢাকা থাকে। ওকে বলতে ভয় পাচ্ছি। ও খুব ভেঙ্গে পড়তে পারে। প্রায় প্রতিদিন ফোন করে এই আশংকার কথা বলতো। বড়ভাইকে বললাম। তাকে নিষেধ করলাম অন্য কাউকে জানাতে।
এরপর আমার দুই বন্ধুকে ফোন দিলাম। কোন ঝামেলা হলেই এদের শরনাপন্ন হই। একজন কে বললাম আমার বউ এর সাথে কথা বলে তাকে আমার শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার জন্য বলতে। আর একজন দুরে বসে অসহায়ের মতো ছটফট করছে আর আমাকে সাহস দিচ্ছে। এরপর বউ ফোন দিল। আমি ধরতেই বলল বাসায় আস। আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না। আমি হেরে গেলাম। কিছু বলতে পারলাম না। দুই চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছিল। আমি ওদের বিপদের মুখে ঠেলে দিছি।
যে দুজন এস.আই সাথে ছিল, তারা গিয়ে মেনথলসহ কিছু ওষুধ কিনে আনলো। আর জি.আর শাখার একজন কনস্টেবল লবঙ্গ, গোল মরিচ, এলাচ, আদা, লেবু, তেজপাতাসহ অনেক ধরনের মশলা কিনে আনলো। আমি শুধু ওদের চেয়ে চেয়ে দেখছি। কিন্তু কিছুই বলতে পারছি না। আমার সকল শক্তি শেষ। যে মানুষটা এই খবর পাওয়ার আগে ৪০ টা মামলার শুনানি করে ১টা আসামির ১৬৪ ধারার জবানবন্দী রেকর্ড করে আরও কাজ করার জন্য ব্যস্ত ছিল- ছিল জীবন শক্তিতে ভরপুর সে কেমন যেন নিঃস্ব, অসহায় আর সবচেয়ে দুর্বল হয়ে গেল। নিজের শরীরটাকে টেনে নেওয়ার শক্তিও তার নেই।
পুলিশরা আমাকে গাড়িতে তুলে দিল। ড্রাইভার কোনভাবেই বিশ্বাস করে না যে আমার করোনা হয়েছে। বেশ কিছুদিন ধরেই ওর গাড়িতে যাচ্ছি। আমার কোন জ্বর নাই, গলা ব্যাথা, হাচি বা কাশি কিছুই নাই। তাই সে বিশ্বাস করে না।
প্রতিদিন আমার মেয়েটা দরজায় টোকা দিলেই বাবা বাবা বলে দৌড়ে আসে। আর আজ! ও রুমের ভেতর থেকে বাবা বলে ডাকল। আমি নিশ্চুপ। সোজা একটা রুমে গিয়ে ঢুকলাম যেটা আমার স্ত্রী আগেই আমার জন্য রেডি করে রেখেছে। রুমে সব কিছু ছিলো। একটা ফ্লাক্স, প্লেট, পানির বোতল, চিরুনি, লুঙ্গি, গামছা, চাকু, লবন, বিভিন্ন মশলা, কিছু ফল, স্যাভলন, সাবান, ডিটারজেন্ট, ব্রাশ, পেস্ট। রুমে ঢুকে স্যাভলন পানি দিয়ে গোসল করে দুপুরের খাবার খেলাম।
এর মধ্যে অনেকেই খবরটা জেনে গেছেন। সবাই উদগ্রীব হয়ে ফোন করছে। একের পর এক ফোন। মন্ত্রলায়, কোয়ার্টার, হাইকোর্ট- সব জায়গা থেকে একের পর এক সিনিয়র স্যারদের ফোন। সবাই পাশে আছে। সবার এক কথা কোন দরকার হলে তাদের যেন সাথে সাথে জানাই। আমি বাসায় আসার ৩০ মিনিট পর দেখি একজন পুলিশ ২টা বক্স নিয়ে বাসায় হাজির। এসপি, ঢাকা মহোদয় পাঠিয়েছেন। স্ত্রী বক্স খুলে জানালো একটায় বিভিন্ন ফলমুল আর একটায় গামছা, চাকু, বিভিন্ন মশলাসহ একজন মানুষের একা চলার জন্য দরকারি সবই। আমি অভিভুত হয়ে গেলাম। একেই বুঝি সেন্স অব হিউমার বলে।
প্রচুর পানি খেয়েছি। প্রতিদিন কমপক্ষে ৫ লিটার। ১টা ৫ লিটার পানির বোতল কিনে রুমে রেখেছিলাম। তিন বেলা খাবার আর পানি নেয়ার জন্য দরজা সামান্য খুলেছি নিশ্বাস বন্ধ করে। দরজা খোলার সময় স্ত্রী ও মেয়ে অন্য ঘরে আছে তা এবং কেয়ার (আমার আত্নীয়) মুখে মাস্ক পরা সব সময় নিশ্চিত করেছি। সে আমাকে এ গুলো দিয়ে সব সময় সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিত। সকল মশলা, আদা, ২টা লেবু, ৩/৪ কোয়া রসুন, কালোজিরা দিয়ে ইলেক্ট্রিক কেটলিতে পানি জ্বালিয়ে তা ফ্লাক্সে ঢেলে রাখতাম। সবসময় ওই পানি খেয়েছি। ভুলেও নরমাল বা ঠান্ডা পানি খাইনি।
তিন বেলা ৩টা লেবু খেয়েছি। আম, কলা, মাল্টা, আপেল খেয়েছি প্রতিদিন। নিজের রুম নিজে স্যাভলন পানি দিয়ে মুছেছি এবং গামছা, লুঙ্গি ধুয়েছি। তিন বেলা স্কিপিং করেছি ও বুক ডাউন দিয়েছি। সকালে ঘুম থেকে উঠে জোরে শ্বাস নিয়ে কিছু সময় ধরে রেখে ছেড়েছি কয়েকবার। ৩/৪ বার Viodin মিশ্রিত গরম পানি দিয়ে গারগল করেছি ও মেন্থল মিশ্রিত গরম পানির ভাপ নিয়েছি। বাকি সময় ফেসবুক আর ফোনে কথা বলে কাটিয়েছি। ১১ টার মধ্যে ঘুম নিশ্চিত করেছি।
সবসময় বিশ্বাস করেছি আমার কিছু হবে না। তবে স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে ভয় সবসময় ছিল। অনেকে নেতিবাচক কথা বললেও গা করিনি। আমি জানতাম আমি কোন অন্যায় করিনি। আমি বাইরে ঘুরিনি। আমি আমার অফিশিয়াল দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হয়তো আক্রান্ত হয়েছি। এর জন্য মন খারাপ করার কিছু নেই, বরং আমার গর্ব ছিল। আমি এই সময় অফিসের কাজকে না বলিনি। এটা অবশ্যই আমার গর্ব।
আমাদের শারীরিক এক্টিভিজম বাড়াতে হবে। প্রতিদিন দৌড়াতে হবে। যে যত বেশি দৌড়াবে সে ততো বেশি ভালোভাবে একে মোকাবেলা করতে পারবে। মোটকথা দৌড়ের উপর থাকতে হবে। রোদ লাগাতে হবে গায়ে। শ্রমজীবী মানুষের তেমন কোন সমস্যা হবে বলে মনে হয় না। আর হ্যাঁ, সবসময় বিশ্বাস রাখতে হবে যে, আমার কিছু হবে না। এত সহজে আমি হারবো না। কখনও কোন করোনা বা অন্য অসুখের রোগীর সাথে নেতিবাচক আচরণ করা যাবে না। এতে তার উপর খুব বাজে রকমের মানসিক চাপ তৈরি হয়, যা তার লড়াই করার শক্তি কমিয়ে দিতে পারে। আসলে কেউ ইচ্ছে করে অসুখে পড়ে না। আমি কিন্তু এখন করোনা নেগেটিভ।
অনেকেই মনে হয় করোনা আক্রান্ত হয়ে ইতিমধ্যে সেরেও উঠেছেন। হয়তো তারা বুঝতেও পারেননি। আমি কিন্তু কোন শারীরিক সমস্যা অনুভব করিনি। আসলে একে ভয় না পাওয়াই ভালো এবং যৌক্তিক। আমার শেষ কথা হলো- 'করোনাকে ভয় নয় বরং জয় করার মানসিকতা ধারণ করা জরুরী...'
বিঃ দ্রঃ- এই লেখাটি রাজিব হাসানের ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে সংগৃহীত।